বুধবার, ১১ জুলাই, ২০১৮

দিল্লির রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান

দিল্লির রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান


ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন                প্রণব কুমার কুণ্ডু

Sambuddha Mukhopadhyay গোষ্ঠীটিতে একটি পোস্ট শেয়ার 
করেছেন: ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য



ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন                প্রণব কুমার কুণ্ডু




Sambuddha Mukhopadhyay ইতিহাস বিশ্লেষণ : 

— Subhasis Chirakalyan Patra এবং আরো 40 জন এর সাথে।

বিশ্বাসঘাতক আর মীরজাফর এখন যেন সমার্থক। আধুনিক ইতিহাসে আমাদের জানা বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনাগুলির মধ্যে পলাশীর যুদ্ধের সেই ঘটনাই সকলেরই সমধিক জানা। কিন্তু মধ্যযুগীয় ইতিহাসের আরেক বীরের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে আরেক রাজার কথা, যিনি দেশ ও জাতির সাথে ঘাতকতা করেছেন, আর তার চরম শাস্তিও পেয়েছেন।
১১৯১ সালে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে মুখোমুখি হন দিল্লীর রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান আর আফগান সুলতান মহম্মদ ঘোরী। ভারতীয়দের মধ্যে অনৈক্য বহুকাল ধরেই এক জ্বলন্ত সমস্যা,কাজেই বিদেশী শক্তির আক্রমণকে প্রতিহত করার বেলায় কোন শক্তিজোটই গঠন হয়নি।সুলতান ঘোরী যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন রাজস্থানের চৌহান সম্রাট বীর পৃথ্বীরাজ ব্যতীত আর কেউ দেশমাতৃকার সম্মান রক্ষার্থে রুখে দাঁড়াননি।পাশে ছিলেন আরেক রাজপুত বীর সংগ্রাম সিং। ১১৯২ এর খ্যাতনামা তরাইনের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ করেন পৃথ্বীরাজ, কিন্তু ঘোরীকে মুক্তি দেন।
ঘোরী আফগানিস্তান ফিরে যান ঠিকই, কিন্তু পরাজয়ের যন্ত্রনা ও শত্রুপক্ষের কৃপাপূর্ণ মুক্তি তাঁকে অসম্ভব লাঞ্ছিত করেছিল, কাজেই মনের মধ্যে জ্বলছিল প্রতিশোধের আগুন। আর সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছিল তাঁর মনোজাত অসন্তোষ। চরম ক্রোধে ঘোরী ঠিক করেন, প্রতিশোধ নিতেই হবে। কিন্তু তিনি জানতেন, পৃথ্বীরাজের নেতৃত্বাধীন রাজপুত শক্তিকে পরাজিত করা মুখের কথা নয়।
কাজেই রাজপুতানার অন্তর্দাহকে ব্যবহার করার দিকে এগোন তিনি, আর গ্রহণ করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের 'শত্রুর শত্রু আমার মিত্র' নীতি, হাল আমলের নেতাজী, হিটলার, মুসোলিনি বা আরো বহু রাষ্ট্রনায়কই যা গ্রহণ করেছেন।
সেইসময় কনৌজ ও বারাণসীর অপর রাজপুত রাজা, গাড়োয়াল সম্রাট জয়চন্দ্রের সাথে পৃথ্বীরাজ চৌহানের শত্রুতার কাহিনী ছিল সুপরিচিত। বস্তুত, জয়চন্দ্রের কন্যা সংযুক্তা ও পৃথ্বীরাজের মধ্যেকার প্রেমের সম্পর্কের আগাগোড়া বিরোধী ছিলেন জয়চন্দ্র। এবিষয়ে কন্যার সাথে বারংবার মতবিরোধ হয় তাঁর।এমতাবস্থায় কন্যার স্বয়ম্বর সভায় পৃথ্বীরাজকে আহ্বান না করে তাকে অপমানও করেন তিনি। কিন্তু, সেইসময়ের প্রচলিত প্রথানুযায়ী, রাজারা তাঁদের পছন্দের রমণীকে 'হরণ' করে নিজের বীরত্বের প্রমাণ দিয়ে বিবাহের পথ প্রস্তুত করবেন। বীর পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে বীরত্বপূর্বক দিল্লীতে নিয়ে এসে সেই রাজপ্রথার পালন করেন। তাঁর বীরত্ব জয়চন্দ্রকে বুঝিয়ে দেয়, পৃথ্বীরাজের মোকাবিলার জন্য তাঁকে তৃতীয় শক্তির সাহায্য নিতে হবে।
কাজেই কনৌজ সম্রাট জয়চন্দ্র ও আফগান সুলতান মহম্মদ ঘোরীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন হয়। ১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহান পরাস্ত হন তাঁর একদা ক্ষমাপ্রাপ্ত সুলতান ঘোরী এবং শ্বশুর তথা স্বজাত জয়চন্দ্রের কাছে। শোনা যায়, ২৬ বছরের বীরযুবক পৃথ্বীরাজকে অন্ধ করে হত্যা করা হয়। কিন্তু তবুও বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে শানিত অস্ত্রাঘাত তাঁকে অমর করে রেখেছে,সেইসাথে বিমূর্ত প্রেমের এক অমর প্রতীক তিনি। পৃথ্বীরাজ-সংযুক্তার এই প্রেমকাহিনী শুধুই সাহিত্য বা ফিল্ম-টেলিফিল্মের উপজীব্যই নয়, এই প্রেমগাঁথা তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে ভারতীয় ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ যুগের সূচনা করেছে : ভারত ইতিহাসের 'মধ্যযুগ',যা বিস্তৃত ছিল পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) পর্যন্ত। বস্তুত, ১১৯২ সালের এই ভবিতব্য যুদ্ধই ভারত ইতিহাসে প্রাচীন যুগ এবং মধ্যযুগের সন্ধিক্ষণ, আর সেই সাথে দিল্লীতে ঘোর বংশের সাম্রাজ্যস্থাপনের কারণে সুলতানি সাম্রাজ্য এক বিশেষ মাত্রা লাভ করে।
কিন্তু ইতিহাস বিশ্বাসঘাতককে কদাচ ক্ষমা করে! এরপর জয়চন্দ্র ভেবেছিলেন পৃথ্বীরাজ তথা চৌহান বংশের পতনের মাধ্যমে তিনিও বিপন্মুক্ত হলেন, কিন্তু তাঁর পথের কাঁটা যে আরো জাঁকিয়ে বসল,সেটা তিনি বুঝতে পারেনইনি। ঠিক এক বছর পরের ঘটনা। মহম্মদ ঘোরীর এই সাম্রাজ্যবিস্তারের পরম্পরা তাঁর উত্তরসূরীরা মান্য করতে থাকেন।কাজেই দিল্লীকে কেন্দ্রিভূত করে পত্তন লাভ করা সুলতানাত আরো বৃহত্তর হতে থাকে।ধীরে ধীরে তাঁদের সাম্রাজ্যের পরিসীমা দক্ষিণে বাড়তে বাড়তে একসময় কনৌজের সীমানায় এসে পৌঁছোয়। জয়চন্দ্র ভাবেন,যে বীজবৎ সাম্রাজ্যকে তিনি ভূমিভেদে সাহায্য করেছিলেন, আজ তা বিশাল মহীরুহে পরিণতি লাভ করে তাঁকে নিশ্চয়ই বৃক্ষতলে ছত্রছায়া প্রদান করবে।কিন্তু হায়! কুতুবউদ্দিন আইবেক, মহম্মদ ঘোরী ও অন্যান্য সেনাপতিদের নেতৃত্বাধীন ঘোর শক্তি জয়চন্দ্রের সাথে কোনরূপ বাক্যালাপেই রাজি ছিল না, তাঁরা স্রেফ তাঁদের সাম্রাজ্য ও ঔপনিবেশিক শক্তিবৃদ্ধির জন্য সমস্ত প্রকার নিধনে রাজী ছিলেন। কাজেই ১১৯৩ সালে অধুনা ফতেপুরে তাঁরা জয়চন্দ্রের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, স্বার্থসিদ্ধিবাজ জয়চন্দ্র যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে পলায়নে বাধ্য হন, কিন্তু পারেননি। দেশ,জাতি, মাতৃভূমির এই বিশ্বাসঘাতকের অসাড় দেহ তলোয়ারের কোপে লুটিয়ে পড়ল ফতেপুরের রণক্ষেত্রে। সুলতানি সাম্রাজ্য দখল করল কনৌজ, বারাণসী,গাড়োয়াল সহ বিভিন্ন অঞ্চল, যেগুলি বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বিহারে বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে।
রাজপুতানার ইতিহাসে এটি অতিপ্রসিদ্ধ একটি কাহিনী। পৃথ্বীরাজ চৌহানের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তাঁর পত্নী তথা কনৌজের রাজকন্যা, জয়চন্দ্র-দুহিতা সংযুক্তা জহরব্রত পালন করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরগতিপ্রাপ্ত হাজারো যোদ্ধার পত্নীরাও আগুনে ঝাঁপ দিয়ে একইভাবে আত্মাহুতি দেন।
না রাজা তাঁর স্ত্রীকে পেলেন দেশের জন্য বলিদান দিয়ে, না নিজেকে বাঁচালেন শত্রুকে ক্ষমা করে, না পিতা তাঁর কন্যাকে পেলেন জামাতাকে হত্যা করে, না পারলেন সু-কন্যার প্রাণই বাঁচাতে, না পারলেন নিজেকে বাঁচাতে। অমর এই প্রেমগাঁথা শুধু তিনটি শীর্ষবিন্দুতে থাকা পিতা-কন্যা-সম্রাটের ত্রিকোণকেই ধ্বংস করল না, ইতিহাসকে এক নতুন মোড় দিল।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন