শিকাগো বিশ্বধর্মসন্মেলন : অতিকথন থেকে নির্মোহ তথ্যের আলোকে
পর্ব এক :
ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন প্রণব কুমার কুণ্ডু
শিকাগো বিশ্বধর্মসন্মেলন : অতিকথন থেকে নির্মোহ তথ্যের আলোকে
পর্ব এক :
ছোট থেকেই স্কুলেের বইয়ে, শিক্ষক বা অভিভাবকের মুখে অথবা বিখ্যাত-অখ্যাত সাহিত্যিকদের গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধে বারবার করে উঠে এসেছে ১৮৯৩ সালের শিকাগোর বিখ্যাত বিশ্বধর্ম সন্মেলন তথা বিবেকানন্দের বিশ্ববিজয়ের কাহিনী। কাহিনীগুলি থেকে সচারাচর এটাই ধারনা হয় যে ১৮৯৩ সালে শিকাগোতে বোধহয় স্রেফ বিশ্ব ধর্মসন্মেলনই হয়েছিল যাতে বিবেকানন্দের একটা বক্তৃতাই তাঁকে আপামর আমেরিকাবাসীর কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। একটা কাজ করলে তো হয়, একটু নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বসে বিচার করে দেখলে হয় না কি, এই কাহিনীর মধ্যে কতোটা মিথ আর কতটুকুই বা ট্রু ফ্যাক্ট।
গোড়াতেই একটা বিষয় পরিস্কার করে নিতে চাই। এই লেখার মাধ্যমে কাউকে ছোট করবার বা অহেতুক সমালোচনা কোনো লক্ষ্য নেই। বাঙালীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক অথবা ধর্মীয় জীবনের উপর বিবেকানন্দের সুপ্রভাব বা কুপ্রভাব নিয়ে আলোচনা করাও আমার লক্ষ্য নয়। আমার একমাত্র প্রয়াস কিছু তথ্যকে আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করা।
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা পদার্পণের চারশো বছরপুর্তি উদযাপন উপলক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৯৩ সালে একটি বিশ্বমেলার (World's Fair) বা বিশ্ব কলম্বীয় প্রদর্শনীর (World's Colombian Exposition) আয়োজন করা হয়। ১ মে থেকে ৩০ অক্টোবর অর্থাৎ ছয়মাস ব্যাপী চলা মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল শিকাগোর Jackson Park এবং Midway Plaisance এর ৬৯০ একরের সুবিশাল প্রাঙ্গনে।
বেঞ্জামিন সি ট্রুম্যানের লেখা History of the World's Fair থেকে এই মেলা অথবা প্রদর্শনীর পুর্নাঙ্গ ইতিহাস পাওয়া যায়। মেলার আট বছর বাদে মার্কিন সরকার দুইটি সুবিশাল বই ছাপে।
প্রদর্শনীটির লে-আউটের দায়িত্বে ছিলেন ড্যানিয়েল ব্রুহ্যাম সহ চারজন ব্যক্তিত্ব। প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে ফ্রেঞ্চ নিওক্ল্যাসিক্যাল আর্কিটেকচারের উপর ডিজাইন করা ছোটবড় মিলিয়ে দুশোটি বাড়ি তৈরি হয়েছিল, যার সবগুলিই সাদা রঙের - নাম দেওয়া হয়, হোয়াইট সিটি।
মেলার অন্যতম বড় আকর্ষন ছিল একটি সুবৃহৎ জলাশয় (water pool), কলম্বাসের সমুদ্রযাত্রার স্মৃতিতে। পুরো মেলা গ্রাউন্ডটাই যেন ছিল একটা অ্যামিউজমেন্ট পার্ক। কোথাও কার্নিভাল রাইড, তো কোথাও ফেরিস হুইল। একদিকে ছিল কলম্বাসের তিনটি জাহাজের ফুল সাইজ মডেল, অন্যদিকে চলছিল চলমান চিত্রপ্রদর্শনী। আর এক কোনে তৈরি হয়েছিল প্রথম চলমান রাস্তা। দর্শনার্থীদের জন্য ছিল নুতন ডিজাইনের ট্রেন। ছিল অজস্র অার্ট গ্যালারি ও প্রত্নতত্ত্বের গ্যালারি। ছিল বিভিন্ন আগ্নেযা়স্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শনের প্যাভিলিয়ন, আর্কিটেকচার প্যাভিলিয়ন, হর্টিকালচার প্যাভিলিয়ন, এগ্রিকালচার প্যাভিলিয়ন, ইলেকট্রিসিটি প্যাভিলিয়ন, ফিশারিজ এবং ফরেস্ট্রি প্যাভিলিয়ন। এমনকি নারীদের জন্য তৈরি হয়েছিল সম্পুর্ন আলাদা একটি প্যাভিলিয়ন !
মোট ৪৬ টি দেশের সাতাশ মিলিয়ন মানুষ অংশ নিয়েছিলেন এই রাজকীয় প্রদর্শনীতে। প্রতিটি দেশের জন্য ছিল তাদের নিজস্ব কালচার ও টেকনোলজি প্রদর্শনের জন্য আলাদা আলাদা প্যাভিলিয়ন।
এসেছিলেন বিখ্যাত নর্তকি 'লিটল ইজিপ্ট' তাঁর বেলি ডান্স নিয়ে। ছিলেন সুবিখ্যাত ভায়োলিন বাদক জোষেফ ডগলাস, অপেরা সিঙ্গার সেসিরেটা জোন্স, পিয়ানোবাদক স্কট জপলিন, বিভিন্ন দেশের মিউজিক ও মিউজিশিয়ান। ছিল জন ফিলিপ সৌসার ব্যান্ড।
আসা যাক বক্তৃতার অধিবেশনগুলিতে। মোট কুড়িটি বিষয়ের উপর বিভিন্ন হলে হাজার হাজার এক্সপার্ট তাদের লেকচার পেশ করেছিলেন। বিষয়গুলি ছিল নারী প্রগতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, চিকিৎসা, সঙ্গীত, আইনসংস্কার, ধর্ম, সাহিত্য ইত্যাদি। প্রতি বিষয়ের লেকচার অর্গানাইজ করবার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি গঠিত হয়েছিল।
উপরোক্ত আলোচনার পর একথা বোধহয় বলাই বাহুল্য যে ধর্মমহাসভা ছিল এই সুবিশাল প্রদর্শনী বা বিশ্বমেলার একটি ক্ষুদ্র অংশ। মেলার অজস্র অ্যামিউজমেন্টের সাথে যে কুড়িটি বিষয় নিয়ে আলোচনাসভা অনুষ্টিত হয়েছিল, এই সন্মেলন ছিল তারই একটা - এর বেশি কিছু নয়।
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, মিথমুক্ত বিবেকানন্দ (রাজাগোপাল চট্টোপাধ্যায়)
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন