মঙ্গলবার, ৩১ জুলাই, ২০১৮

ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কা


    ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কা


     ফেসবুক থেকে         শেয়ার করেছেন           প্রণব কুমার কুণ্ডু


আজ কথা বলব এক বিখ্যাত বীর শহীদের কথা, যার আত্মবলিদানের জন্য নিষ্ঠুরতম হত্যালীলা থেকে বেঁচে যায় আমার শহর- আগরতলা।
সন ১৯৭১। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে চলছে পাকিস্তানিদের দ্বারা বাঙালী নিধনযজ্ঞ। সেই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের হাজারো মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে ভারত। কলকাতা ও আগরতলার বাঙালীদেরও ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে কলকাতা ও আগরতলা, দুই শহরই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এমত পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ১৯৭১ সনের ৩ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে আক্রমণ করে বসে। তাদের গোপন পরিকল্পনা ছিল হঠাৎ করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালালে ভারতের নজর পশ্চিমদিকে চলে যাবে, সেই সুযোগে অতর্কিতে লাগোয়া রাজ্য ত্রিপুরা আক্রমণ করে রাজধানী আগরতলার দখল নেওয়া যাবে। এতে আন্তর্জাতিক স্তরে পাকিস্তানের অবস্থান সুদৃঢ় হবে, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী ভিতকে দুর্বল করে দেওয়া যাবে।
তবে পাকবাহিনীর এই গোপন পরিকল্পনার কথা ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে আগেভাগেই চলে আসে। ভারতীয় গোয়েন্দাবাহিনী জানতে পারে পাক সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা জেলা থেকে আখাউড়া হয়ে আগরতলায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে। তাই কুমিল্লা জেলার গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় অস্থায়ী সেনাশিবির স্থাপন ও বাঙ্কার তৈরি করে জওয়ান মোতায়েন ও অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করে রাখে তারা।
১৯৭১ সালে ৩রা ডিসেম্বর পাকবাহিনী স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে আক্রমণ শুরু করে। ভারতীয় বাহিনী তাদেরকে উপযুক্ত জবাব দেয়। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা এলাকায় পাক সেনাশিবির লক্ষ্য করে ভারতীয় সেনারা পাল্টা আক্রমণ চালায়।
১৪ গার্ড রেজিমেন্টের মেজর ও পি কোহলি'র নেতৃত্বে ভারতীয় সময় রাত ২টায় আলফা ও ব্রাভো এই দুই কোম্পানির সেনা জওয়ান কুমিল্লা সেক্টরের গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) প্রবেশ করে। রেলের দুটি ট্রেক ধরে ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কা ও ল্যান্স নায়েক গোলাব সিং'র নেতৃত্বে দুটি লাইনে ভারতীয় সেনা জওয়ানরা এগিয়ে যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে তাদেরকে নজর রেখে রেল লাইনের নিচের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন মেজর কোহলি।
রাত আড়াইটে নাগাদ ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কার পা পাকবাহিনীর পাতা ফাঁদে লেগে যায়। সঙ্গে সঙ্গে গোটা এলাকা আলোয় আলো জ্বলে ওঠ। ভারতীয় সেনাদের দেখে ফেলে বাঙ্কারে থাকা পাক সেনারা। প্রহরারত এক পাকসেনা চেঁচিয়ে উঠতেই শুরু হয় গুলির লড়াই। বছর আটাশের ল্যান্স নায়েক এক্কা এগিয়ে গিয়ে বাঙ্কারে থাকা পাক বাহিনীর জওয়ানদের খতম করেন। এলবার্ট এক্কা তার সঙ্গী ল্যান্স নায়েক গোলাব সিং, মেজর কোহলি সহ দুই কোম্পানির মোট ২৪০ জন জওয়ান পাকসেনাদের পরাস্ত করে একের পর এক বাঙ্কারের দখল নিতে থাকেন। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে যুদ্ধ করার সময় পাক বাহিনীর ছোড়া একটি গুলি এলবার্ট এক্কা'র বাঁ হাতে লাগে। তারপরও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই অবস্থায় আরো একটি গুলি এসে লাগে এলবার্ট এক্কার গলায়। তিনি মাটিতে পড়ে যান কিন্তু দমে যাননি। উঠে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেন রেলের উচু সিগন্যাল রুম থেকে ভারতীয় সেনা বাহিনীর দিকে গুলি ছুটে আসছে। তখন তিনি সিগন্যাল রুম লক্ষ্য করে উপরের দিকে গ্রেনেড ছোড়েন। গ্রেনেডে একাধিক পাকসেনার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।কিন্তু নিজের ছোড়া গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে গুরুতর জখম হন এলবার্ট এক্কা। তার শরীরের অঙ্গপ্রতঙ্গ বেরিয়ে যায়। এই অবস্থায় তিনি লক্ষ্য করেন, এক পাক সেনা সিগন্যাল রুম থেকে ভারতীয় জওয়ানদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। নিজের ক্ষত স্থান চেপে ধরে লোহার সরু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে শেষ পাক সেনাকে বধ করে নিচে নামার সময় শহীদ হন।
সেই রাতে এলবার্ট এক্কার পাশাপাশি আরো ১১জন ভারতীয় বীর জওয়ান শহীদ হন। এরা হলেন গোলাব সিং, কাশীনাথ সাহু, ডেভিড টিগ্যা, মার্গ গিয়াত সিং, উবাও সিং, রামদেও সাহু, কেশর দেব, দাল সিং, যোসেফ টোপনো, শিব নারায়ণ ও দূর্গা প্রসাদ। সেই রাতে প্রায় সব পাকসেনাকে খতম করতে সক্ষম হয়েছিলেন ভারতীয় বাহিনীর জওয়ানরা। এই অভিযান শেষ হতে হতে দিনের নতুন আলো ফুটে ওঠে।
পরে শহীদ ভারতীয় জওয়ানদের আগরতলার বাধারঘাটের শ্রীপল্লী এলাকায় সমাধিস্ত করা হয়। এখানে একটি স্মৃতিসৌধ বানানো হয়েছে তাদের স্মৃতির উদ্যেশে।
ওই রাতের লড়াইয়ে পাক বাহিনীর মনোবল একেবারে ভেঙ্গে যায়। তারা সম্মুখ সমরে আগরতলা আক্রমণের পরিকল্পনা থেকে পুরোপুরি সরে দাঁড়ায়।পরবর্তীকালে পাকবাহিনী যুদ্ধবিমান ও কামান থেকে গোলা ছুড়ে আগরতলায় ক্ষয়ক্ষতির চেষ্টা করলেও সরাসরি আক্রমণের সাহস করেনি।
অসীম সাহসের জন্য ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কাকে ভারত সরকার সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ সম্মাননা পরমবীর চক্র প্রদান করে। এক্কা'র বাড়ি ভারতের বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজধানী রাঁচী শহরের পাশে গুমলা ব্লক এলাকায়। রাঁচী শহরের একটি জায়গায় এক্কার একটি মূর্তি বসানো আছে। জায়গাটি এলবার্ট এক্কা চক নামে খ্যাত। ভারত সরকার এলবার্ট এক্কার নামে ডাক টিকিটও প্রকাশ করেছে।

লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
মন্তব্য করুন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন