মঙ্গলবার, ১৭ জুলাই, ২০১৮

কালাপাহাড় ( দুই )


   কালাপাহাড় ( দুই )


    ফেসবুক থেকে         শেয়ার করেছেন                প্রণব কুমার কুণ্ডু



কালাপাহাড় : এক অসাধারণ প্রেমিকের, নৃশংস হিন্দুবিদ্বেষীর হয়ে ওঠার কাহিনী

# সলিল হোড়

" সময়টা ছিল পঞ্চদশ শতক। বাংলাদেশের গৌড়ের শাসক তখন সুলায়মান খান কররানী। সেখানে তার সেনাবাহিনীতে এক দক্ষ ব্রাহ্মণ সেনানী ছিলেন রাজীবলোচন রায়, যিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজশাহীর অধিবাসী। অত্যন্ত সুদর্শন, বিদ্বান ও বুদ্ধিমান রাজীব ছিলেন এক নিষ্ঠাবান বিষ্ণুভক্ত। কররানীর সেনাবাহিনীতে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়ে, তিনি সুলতানের সুনজরে ছিলেন, আর সেই জন্যই তার অন্দরমহলে যাতায়াতের অনুমতি ছিল রাজীবের।
একদিন এই অন্দরমহলেই রাজীব দেখা পান কররানীর এক মেয়ে, দুলারী বিবির। প্রথম দর্শনেই রাজীব মুগ্ধ হন, যাকে বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট! কিছুদিন পরে দুলারী বিবির থেকেও সাড়া আসতে থাকে। শুরু হয় রাজীব আর দুলারীর প্রেমকাহিনী। একবার ভাব, সেই সময়ে হিন্দু ছেলে আর মুসলিম মেয়ের মধ্যে প্রেম! যাই হোক, অসীম সাহসী রাজীব, একদিন মেয়ের বাবার কাছে, মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। কররানী প্রথমে খুব অবাক হলেও, পরে ব্যাপারটা মেনে নেন। রাজীবকে নিজের প্রধান সেনাপতির পদে আসীন করেন, আর ইসলামমতে বিয়ে হয় রাজীব-দুলারীর। রাজীব কিন্তু তখনো নিজের ধর্ম পরিত্যাগ করেন নি।
এই বিয়ের ফলে, তৎকালীন গোঁড়া হিন্দু সমাজে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। রাজীবকে আর তার পরিবারকে সমাজে একঘরে করে দেওয়া হয়। রাজীবের মা ছেলেকে অনুরোধ করেন যে প্রায়শ্চিত্ত করতে, কিন্তু বাংলার হিন্দু ধর্মগুরুরা, তাকে কোনোরকম বিধান দিতে অস্বীকার করেন। এর কিছুদিন পরে, রাজীব সস্ত্রীক পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে প্রায়শ্চিত্ত করতে গেলে, মন্দিরের পুরোহিতরা খুব খারাপ ব্যবহার করে তাদের তাড়িয়ে দেন। এর ফলে, প্রতিশোধস্পৃহাতে অন্ধ হয়ে, রাজীব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, এবং হয়ে ওঠেন প্রবল হিন্দু বিদ্বেষী, কুখ্যাত হয়ে ওঠেন 'কালাপাহাড়' নামে।
এরপর থেকে শুরু হয়, কালাপাহাড়ের হিন্দু মন্দির আক্রমণ, প্রতিমা ধ্বংস ও লুটপাটের কাহিনী। সম্ভবত ইংরেজি ১৫৬৮ সালে, কালাপাহাড় আক্রমণ করেন পুরীর জগন্নাথ মন্দির। মন্দিরে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়ে, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার কাঠের প্রতিমা উপড়ে, হুগলি নদীর তীরে নিয়ে গিয়ে সেগুলো জ্বালিয়ে দেন।
মন্দির আক্রমণের পদ্ধতি একটু অভিনব ছিল কালাপাহাড়ের। মন্দিরের ভিতরে বড়ো বড়ো পিতলের ঘন্টা আর গরুর চামড়ার বিশাল ঢোল বাজিয়ে এমন ভাইব্রেশন তৈরি করা হতো, যাতে এমনিতেই প্রতিমাতে ফাটল ধরে যায়, আর হাতগুলো খসে পরে। তারপর সবার সামনে প্রতিমা উপড়ে ফেলা হতো। তৎকালীন উড়িষ্যা এবং আসামের একটা বড়ো অংশে কালাপাহাড় তার অভিযান চালিয়েছিলেন। বালেশ্বরের গোপীনাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরের কাছে কোনারক মন্দির, মেদিনীপুর, ময়ূরভঞ্জ, কটক ও পুরীর মন্দিরগুলো, আর এদিকে আসামের কামাখ্যা ও হাজোর মন্দিরগুলোতে তিনি অবাধে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়েছিলেন।
হিন্দু মন্দির ধ্বংসের সাথে সাথে, আজীবন মুঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন কালাপাহাড়। কররানীদের পতনের পর, কালাপাহাড় সম্ভবতঃ আফগান নেতা মাসুম কাবুলীর দলে যোগ দেন। সম্ভবতঃ ইংরেজি ১৫৮৩ সালে, মুঘল সেনাপতি খান ই আজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কাবুলী পরাস্ত হলে, সেই যুদ্ধে কালাপাহাড়ও নিহত হন। ওড়িশার সম্বলপুরে, মহানদীর তীরে কালাপাহাড় ও তার সহযোদ্ধাদের সমাধিস্থ করা হয়।"
তাহলে ওদিকে গেলে দেখা যাবে তো কালাপাহাড়ের সমাধি?

আর সমাধি! কালাপাহাড় মন্দির নষ্ট করেছিল, আর সেই জন্য ২০০৬ সাল নাগাদ কিছু উগ্র হিন্দুবাদীর আক্রোশে তার সমাধি ধ্বংস হয়!



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন