সোমবার, ২৩ জুলাই, ২০১৮

অতুলপ্রসাদ সেন


     অতুলপ্রসাদ সেন


      ফেসবুক থেকে       শেয়ার করেছেন      প্রণব কুমার কুণ্ডু



অতুলপ্রসাদ সেন-- দুঃখের ফল্গুধারায় বহমান এক জীবন
---------------------------------------------------------------------------------
" মনোদুখ চাপি মনে হেসে নে সবার সনে,
যখন ব্যথার ব্যথীর পাবি দেখা
জানাস প্রাণের বেদন।"

হাসিখুশি, আড্ডাবাজ,মজলিশী মানুষদের অন্তরেই থাকে বোধহয় এক রাশ কান্না। এঁদের হাসি খুশি চেহারা দেখে বোঝার উপায় থাকে না মনের গভীরে এদের কতখানি ব্যথা। লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যরিষ্টার, গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী অতুলপ্রসাদকে যে জীবনের ভার বইতে হয়েছিল তা যেমন অকল্পনীয় -তেমনি অভাবিত। নাটকের মতই হৃদয়গ্রাহী, মর্মস্পর্শী।
দুটি ঘটনা অতুলপ্রসাদের জীবনকে তোলপাড় করে দিয়েছিল। একটি হল তাঁর মায়ের বিয়ে। আরেকটি তাঁর নিজের বিয়ে।
অতুলপ্রসাদ তখন কিশোর। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে তাঁর মা হেমন্তশশী সহ বোনেদের নিয়ে মামাবাড়ীর ছত্রছায়ায় বাস করছেন। হঠাৎ একদিন দেখলেন মামাবড়ী যেন থমথম করছে। মাসীরা কাঁদছে, বোনেরা কাঁদছে, কাঁদছেন দিদিমা। অতুলপ্রসাদ কথাবার্তায় বুঝলেন, তাঁর মা হেমন্তশশী দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন এবং যাঁকে বিয়ে করেছেন তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জ্যাঠামশাই দুর্গামোহন দাশ।
সন্তান সবকিছু সইতে পারে কিন্তু মায়ের বিয়ে? অসম্ভব। এভাবে মায়ের পর হয়ে যাওয়া সইবে কেমন করে? তীব্র অভিমানে অব্যক্ত যন্ত্রনায় বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল, চোখের জলে ঝাপসা হয়ে গেল বুঝি তার ভবিষ্যৎ! বাবাকে হারিয়ে এতদিন মা ছিল তাঁর সবকিছু, সেই মা কিনা..।
অশান্ত মন নিয়ে অভিমানী ছেলে পদ্মা নদীর দেশ ছাড়লেন। বোন হিরণ -কিরণ-প্রভাকে কলকাতায় দুর্গামোহন দাসের বাড়ীতে মায়ের কাছে পৌঁছে দিলেন। মায়ের সাথে দেখা করলেন না। চলে গেলেন পানি মামার বাড়ী। সেখান থেকে বড় মামার কাছেে। ভর্তিহলেন প্রসিডেন্সী কলেজে।
মামারাও বোনের এই ঘটনায় বিব্রত। অতুলের প্রতি সমবেদনায়, তাঁর ক্ষতবিক্ষত মনকে শান্ত করতে দুর দেশে পাঠিয়ে দিলেন।অতুলপ্রসাদ ব্যারিষ্টার হওয়ার লক্ষ্যে লন্ডনে এলেন। ভর্তি হলেন মিডল টেম্পলে। প্রবাসী বাঙ্গালীদের মত দীর্ঘদিন ঘরছাড়া অতুলপ্রসাদও অনুভব করেন সুজলা সুফলা বাংলা মায়ের টান। মা হেমন্তশীর জন্য মন কেঁদে উঠল। বিয়ের পর আত্মীয় স্বজনেরাও তাঁর মাকে পরিত্যাগ করেছিল । মনের এই রকম অবস্থায় বড়মামা সপরিবারে কোন কাজে বিলতে আসেন।
বন্ধ জানালা খুলে এক ঝলক খুশির বাতাস বয়ে আনল অতুলপ্রসাদের জন্য। বিদেশ বিভুঁইয়ে, কাছে পেলেন বড়মামাকে, মামীকে। আর পেলেন মামাতো বোন হেমকুসুমকে। সুন্দরী, ব্যক্তিত্বপূর্ণা, সপ্রতিভা সাহসিকতার ছটায় উজ্জ্বল হেমকুসুমকে নিয়ে আনন্দের জোয়ারে ভেসে গেলেন অতুলপ্রসাদ। হেমকুসুমের অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতা অতুলপ্রসাদের হৃদয়ে এক অজানা শিহরণ, অচেনা আকর্ষণ। পরস্পর মুগ্ধ দুটি হৃদয়।
মুগ্ধতার রেশ জারি ছিল কলকাতাতেও। অতুলপ্রসাদ ব্যারিষ্টারি পাশ করে কলকাতা ফিরে সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা বিয়ে করবেন। অশান্তির আগুন জ্বলে উঠল দুটি পরিবারে। ঝড় উঠল আত্মীয় সমাজেও। কিন্তু অতুলকে দমানো গেল না। ওদিকে প্রচন্ড জেদী হেমকুসুম তাঁর মাকে জানিয়ে দেয় অতুলকে না পেলে সে আত্মহত্যা করবে।
সামাজিক বিধি ব্যবস্থায় ভাইবোনের বিয়ে কোনমতে গ্রহণযোগ্য নয়, আইনসিদ্ধও নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিং এর পরামর্শে বিলেত গিয়ে কোন এক গির্জায় দুজনে বিবাহ সুত্রে আবদ্ধ হলেন। আত্মীয়-স্বজন সবাই ওদের পরিত্যাগ করায় ওরা বিলেতেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। অতুলপ্রসাদ ওখানেই প্র্যাকটিশ শুরু করলেন।
হেমকুসুমের কোলজুড়ে এল ফুটফুটে যমজ সন্তান। দিলীপ কুমার ও নিলীপ কুমার । কিন্তু অতুল প্রসাদের মনে সুখ নেই। পসার জমছে না। এদিকে টাকা পয়সাও প্রায় শেষ। হেমকুসুম তাঁর গয়নাগাটি একটি একটি করে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। অতুলপ্রসাদ আত্মীয় বন্ধুদের চিঠি লিখেছিলেন। কোন উত্তর আসেনি। মা বোনেদেরও সাড়া মেলেনি।
একে তীব্র অর্থাভাব তার উপর আত্মীয় -স্বজন তথা স্বদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অতুল প্রসাদ মানসিক যন্ত্রনায় অস্থির। হেম সাহস দেন। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না। শেষ রক্ষা হল না। তীব্র ঠান্ডায় শীতবস্ত্রের অভাব ও প্রয়োজনীয় ওষুধ পথ্য যোগাড় করতে না পারায় নিলীপ কুমারের মৃত্যু হল। হতাশায় ভেঙ্গে পড়লেন দুজনেই।
নিরুপায়, নিঃসঙ্গ একান্তভাবে অবসন্ন উভয়েই। কোথাও এতটুকু হাত ধরার কেউ নেই। নেই আশ্বাস। শেষ পর্যন্ত একজন ভারতীয় বন্ধু মমতাজ হোসেনের পরামর্শে দেশে ফিরে এলেন। লক্ষ্ণৌতে এসে প্র্যাকটিশ শুরু করলেন। ধীরে ধীরে পসার জমে উঠল। হেমকুসুম স্নিগ্ধ আন্তরিকতা দিয়ে সযতনে গড়ে তুললেন তাঁর সংসার। কিন্তু অশান্তি শুরু হল তখনই যখন তাঁর শ্বাশুড়ি বিধবা হেমন্তশশী বাড়িতে থাকতে এলেন।
মা হেমন্তশশী আজ একা। অতুলপ্রসাদ আজ অর্থ, যশ আর জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ চুড়ায়। তাঁর মায়ের জন্য মন কাঁদে। কিন্তু হেমকুসুমের মন তাতে বিদ্রোহ করে। হেমকুসুম ভুলতে পারেন না তাদের যাঁরা তাঁদের বিয়ে মেনে নিতে পারেনি-তাদের সাথে কোন সম্পর্ক নয়, নয় কোন আত্মীয়তা। তাছাড়া বড় বড় ছেলে মেয়ে থাকা সত্বেও শ্বাশুড়ির দ্বিতীয়বার বিয়ে হেমেকুসুমের কাছে বিকৃত মানসিকতার পরিচয়। এমন শ্বাশুড়িকে সে মেনে নিতে পারে না।
শুরু হল শ্বাশুড়ি-বৌমার সেই অনিবার্য সংঘাত। আমাদের দেশে চিরাচরিত প্রথামত প্রণয় ঘটিত অঘটনে মেয়েদেরই দায়ী করা হয়। হেমন্তশশীও এই বিয়ের ব্যাপারে হেমকুসুমকে দায়ী করে বার বার অসন্তোষে ঝলসে উঠেছেন। অপরদিকে হেমকুসুম বিদেশে নিঃস্ব অবস্থায় স্বামী সন্তানদের নিয়ে সেই দুঃখের দিনগুলি ভুলতে পরেন নি, ভুলতে পারেন নি অভাবের মধ্যে অসহায় অবস্থায় সন্তানের মৃত্যু ও তার নিদারুণ শোক। ভুলতে পারেননি শ্বাশুড়ী -ননদদের উদাসীন, ক্ষমাহীন ব্যবহার।
যে সংসারে শ্বাশুড়ী বৌমা কিংবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ-সেই সংসারে অশান্তির আবহে পড়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বোধহয় শিশুরা। একদিকে মা -বাবর মধ্যে অশান্তি অন্যদিকে ঠাকুমার সাথে মন কষাকষি -এর মধ্যে পড়ে দিলীপকুমারও পড়াশোনায় মন বসাতে পারেনি।বার বার নিষেধ করা সত্বেও মাকে নিয়ে এসেছেন স্বামী। তাই হেমকুসুমের যত রাগ গিয়ে পড়ত স্বামীর উপর। একদিকে মা এবং অন্যদিকে স্ত্রী -এই দুয়ের মাঝখানে পড়ে অতুল প্রসাদ হলেন ক্ষুব্ধ, নিরাশ। তাঁর হৃদয় হল ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত।
হেমন্তশশী বুঝলেন তাঁকে নিয়েই সংসারে অশান্তি। ছেলের নির্বাক,শুকনো মুখ তিনি সহ্য করতে পারলেন না। চলে গেলেন বাড়ী ছেড়ে। হেমের কারণেই মাকে চলে যেতে হল। এই ভাবনায় ধনী, মানী, যশস্বী অতুলপ্রসাদ দুঃখের আগুনে পুড়তে থাকলেন। অশান্তি তার ঘরের বাতাসকে দুষিত, উত্ত্প্ত করে তুলেছে। মা চলে যাবার পরে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ক্রমেই নিরানন্দ,তিক্ত, অসহ হয়ে উঠল। দুজনের সম্পর্কের মাঝে একটা দেয়াল খাড়া হয়ে উঠল।
অশান্তি যখন চরমে তখন একদিন হেমকুসুম রাগের বশে অতুলপ্রসাদের ব্যরিষ্টারীর সমস্ত পোষাক ঘরের বাইরে কেরোসিন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলেন। হেমকুসুমের হৃদয়হীন আচরণ ও নিষ্ঠুর ব্যবহারে ক্ষুব্ধ অতুল প্রসাদ পরের দিন হেমকে না জানিয়ে লক্ষ্ণৌ ছেড়ে কলকাতায় চলে গেলেন। যাবার আগে পারিবারিক বন্ধু মহেশ চট্টোপাধ্যায়ের উপর স্ত্রী পুত্রের ভার দিয়ে গেলেন। কলকাতা হাই কোর্টে যোগ দিয়ে প্র্যাকটিশ শুরু করলেন।
কলকাতা থেকে অতুলপ্রসাদ গেলেন শান্তিনিকেতনে শান্তির খোজে গুরুদেবের কাছে।ফিরে এসে গেলেন দার্জিলিং। মনোরম পরিবেশে মানসিক সুস্থতার আশায়। তারপর গেলেন ঢাকায় প্রিয় জন্মভূমিতে। ফিরে এসে গেলেন সারদা মায়ের কাছে। সমস্ত বেদনা, যন্ত্রণা কান্না হয়ে ঝরে পড়ল মায়ের পায়ে। মনের দুঃখ ভুলতে আবার পাড়ি দিলেন সুন্দর বনের উদার প্রকৃতির মধ্যে।
ওদিকে লক্ষ্ণৌর বাড়ীতে একা হেমকুসুম। কিছুতেই ভুলতে পারছেন না প্রিয় অতুলের নিষ্ঠুর ব্যবহার। মনে জাগে নানা প্রশ্ন। সর্বস্ব পণ করে যাঁরা পরস্পরকে ভালোবেসে ছিল বিধাতার নিষ্ঠুর পরিহাসে কেন সেই মধুর সম্পর্ক পুড়ে ছাই হল? কেন অতুল বুঝতে চাইছে না তাঁর হেমকে? অসহনীয়-অভাবনীয়-অবর্ণনীয়-অসহায়তা কেন হেমকুসুমের হৃদয় জুড়ে? সবটা কি তারই দোষে?
অতুলপ্রসাদের গতিবিধির খবর রাখতেন হেমকুসুম। দার্জিলিং এ আছেন খবর পেয়ে অনুতাপে জর্জরিত হেমকুসুম পুত্র দিলীকুমারকে সঙ্গে নিয়ে দার্জিলিঙে গেলেন। কিন্তু পাহাড়প্রমান অভিমান দুজনকে মিলতে দিল না। পাশাপাশি দুটি হোটেলে থাকলেন। ফিরে এলেন কলকাতায়। বাড়ী ভাড়া করে থাকতে লাগলেন। সঙ্গে পুত্রের শিক্ষক হিসেবে মহেশ চট্টোপাধ্যায়।
সারাদিনের কাজের শেষে অতুলপ্রসাদ ক্লান্ত। বিধ্বস্ত। একটা বিষাদ ছেয়ে থাকত মন জুড়ে। কেন এমন বদলে গেল হেম? আগে নিষ্ঠুরতা দেখালেও আবার দরদী মন নিয়ে প্রয়োজনে অতুলপ্রসাদের পাশেে এসে দাঁড়াত। আর এখন? একই জায়গায থেকেও দুজনের মুখ দেখাদেখি নেই। ছেলেকেও বাবার কাছে আসতে দেয় না। যা বাংলাদেশের আবহাওয়ায় দৃষ্টিকটু।
এখান থেকে চলে যাওয়াই স্থির করলেন। হেমের থেকে দুরে। আবার এলেন লক্ষ্ণৌ। হেমকুসুমের দুর্ব্যবহার, অশোভন আচরণ এখানে আর রইল না। অতুলপ্রসাদ নিজকে ছড়িয়েে দিলেন গানে,মজলিশে সাহিত্যে, সেবার কাজে। তিনি হলেন সারা লক্ষ্ণৌবাসীর প্রিয় 'সেন সাহেব'।
অতুলপ্রসাদের নীরব উপেক্ষায় হেমকুসুম শরীরে মনে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দিশেহারা অসহায় পুত্র দিলীপকুমার বাবাকে সেই বার্তা দেওয়ার পর বাবারই নির্দেশেই মাকে নিয়ে লক্ষ্ণৌতে এলেন। অন্তবিহীন পথ পেরিয়ে আবার মিলন ঘটল দুটি প্রাণের। দুজনেই উৎফুল্ল, অনুরাগ-রঞ্জিত। আবার হারানো সবকিছু ফিরে পেলেন হেমকুসুম।
কিন্তু সে আনন্দ স্থায়ী হল না। কিছুদিনের মধ্যেই হাজির হলেন মা হেন্তশশী,বোন হিরণ -কিরণ ও প্রভা। অতুলভবনে নেমে এল অশান্তির কালো ছায়া। একদিকে শ্বাশুড়ী ননদ অন্যদিকে হেমকুসুম। মাঝে অসহায় বিব্রত অতুলপ্রসাদ। তেতে উঠলেন হেমকুসুম। পুত্র দিলীপকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ী ছেড়ে চলে গেলেন। চলে গেলেন দেরাদুন।
প্রচন্ড জেদ, অভিমান এবং রাগ মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে -তার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে রইলেন হেমকুসুম। অথচ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার অভাব ছিল না। শুধুমাত্র শ্বাশুড়ী -ননদদের মানতে না পেরে, স্বাধিকার প্রতিষ্টার একক সংগ্রাম করে ক্ষোভের আগুনে দগ্ধ হয়ে কক্ষচ্যুত তারকার মত নিজেকে শেষ করতে লাগলেন। অতুলপ্রসাদেরর নূতন বাড়ী 'হেমন্ত নিবাস' এর উদ্বোধন হল।হেমকুসুম আসেন নি। শ্বাশুড়ীর মৃত্যুর শ্রাদ্ধের সময়ও আসেন নি।
চলৎশক্তি হীন, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অবসন্ন হেমকুসুম অবশ্য দেরাদুন থেকে শেষবারের মত অনেক আশা নিয়ে এসেছিলেন অতুলপ্রসাদের কাছে থাকব বলে। মাস তিনেক ছিলেন। তারপর আবার সেই আত্মীযদের সঙ্গে পুরানো অসন্তোষ ধুমায়িত হয়ে ওঠে। আবার বাড়ী ছেড়ে লক্ষ্ণৌতেই ভাড়ার বাড়ীতে গিয়ে ওঠেন। অতুলপ্রসাদের জীবিত অবস্থায় আর তিনি আসেন নি। একজন ধনী, মানী, যশস্বী মানুষের জীবনের এমন পরিনতি অকল্পনীয়!
তবে সংসার সমুদ্র -মন্থনে শুধু হলাহলই নয়, উঠেছিল অবাক পারিজাত বৃক্ষটি যার কুসুম- সুবাসে আমোদিত হয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। মাত্র ২০৮ টি গান তিনি রচনা করে তিনি গানের জগতে অমরতা লাভ করেছেন -যা এক বিস্ময়! কিন্তু তার চেয়ে বড় বিস্ময় যে কি কারণে অতুলপসাদী গান রবীন্দ্রসঙ্গীতের সর্বব্যাপী প্রভাবও ও জনপ্রিয়তার পাশে জনমনে এমন প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হল!
অনেক গানে তাঁর জীবনকে দেখা যায়। তাঁর বিখ্যাত গানগুলি হল, "ওগো নিঠুর দরদী"; "বঁধু নিদ নাহি আঁখি পাতে" ; "আজ আমার শূন্য ঘরে আসিলে সুন্দর"; "কে আবার বাজায় বাঁশী"; "বঁধু ধর, ধর মালা পর গলে ; "তুমি মধুর অঙ্গে"; "একা মোর গানের তরী "; "পাগলা মনটারে তুই বাঁধ"; "যাব না যাব না ঘরে" ;এত হাসি আছে জগতে তোমার, বঞ্চিলে শুধু মোরে"- ইত্যাদি গান মানুষকে উদ্বেল করে, আবেগাপ্লুত করে।
এ ছাড়াও "ডাকে কোয়েলা বারে বারে"; "আর কতকাল থাকব বসে " ; "মেঘেরা দল বঁধে যায় কোন দেশে"-তাঁর বিখ্যাত গান। স্বদেশ সঙ্গীতগুলির মধ্যে হল, "ওঠ গো ভারতলক্ষ্মী"; "হও ধরমেতে ধীর হও করমেতে বীর"; "শতবীণা বেনু রবে"; "খাঁচার গান গাইব না আর"; " মোদের গরব মোদের আশা" -প্রত্যেকটি কল্পনায়, প্রেরণায়, ভাবে, গুনে অনবদ্য। তাঁর একটি মাত্র গ্রন্থ "গীতিগুঞ্জ" গানের জগতে তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে।
অতুলপ্রসাদের বিশ্রামের অবকাশ নেই। লক্ষ্ণৌ শহরের পাঁচ জনের একজন তিনি। সেন সাহেবকে ছাড়া কোন কাজই যে সম্ভব নয়। অতিথি অভ্যাগতের বিরাম নেই। দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা অতুলপ্রসাদের অতিথি হয়ে তাঁকে সনম্মানিত করেছেন । একে একে এসেছেন মহাত্মা গান্ধী, রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ সরোজিনী নাইডু চিত্তরঞ্জন দাস। এসেছেন রবীন্দ্রনাথ এবং আরও অনেকে।
সব ছেলেই স্বপ্ন দেখে যে স্ত্রী একদিন তার পরিবারকে মেনে নেবে তারপর দুজনে মিলে এক স্বপ্নের নীড় রচনা করবে। অতুলপ্রসাদও সেই স্বপ্ন দেখেছিলেন।কিন্তু তা সফল হয়নি।
অতুলপ্রসাদ সবাইকে আপন করেছেন কিন্তু আপন হলনা সবার চেয়ে যিনি আপন। সবই আছে তবুও সব শূন্য। ধন-সম্পদ-ঘর ঐশ্বর্য, কিন্তু নেই মাধূর্য, নেই পার্বতী। অতুলপ্রসাদ ভেবেছিলেন নিজের ভুল বুঝতে পেরে একদিন না একদিন হেম তার কাছে ফিরে আসবেই। কিন্তু তা হয়নি।
অতুল প্রসাদ অসুস্থ। খবর ছড়িয়ে গেল সর্বত্র। তাদের প্রিয় 'সেন সাহেব' কে দেখার জন্য লক্ষ্ণৌ শহর ভেঙ্গে পড়ল। ডাক্তার এল, নার্স এল। সব সম্প্রদায়ের জনস্রোত ছুটল হেমন্তনিবাসের দিকে -সকলেই একটিবার দেখতে চান। তাঁর সহকর্মীবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা, লক্ষ্ণৌয়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত- অনুপস্থিত কেবল হেমকুসুম।
সকলকে উৎকন্ঠায় রেখে রাত একটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে এই মহৎপ্রাণ মরজগৎ ছেড়ে সুর লোকে চলে গেলেন।খবর পেয়ে রাত দুটোয় এলেন হেমকুসুম। তাঁকে বলা হল 'আপনি অসুস্থ মানুষ গাড়ী থেকে নেমে আর কি করবেন, সবইতো শেষ। ফিরে যান।' মর্মর মূর্তির মত নিষ্পন্দ, নিথর হেমকুসুম রাতের অন্ধকারে ফিরে চললেন। কোথাও আলো নেই, হাওয়া নেই, প্রাণ নেই। কোথা থেকে যেন ভেসে এল অতুলপ্রসাদের গান--

"কেন এলে মোর ঘরে আগে নাহি বলিয়া।
এসেছ কি হেথা তুমি পথ তব ভুলিয়া?....
* * * * * * * * * * * * * * * *

বই:--অতুলন অতুলপ্রসাদ - শ্রী সুনীলময় ঘোষ।
অতুলপ্রসাদ-- মানসী মুখোপাধ্যায়।
অতুলপ্রসাদ সেন-- সুরেশ চক্রবর্তী।
কাকলি --অতুলপ্রসাদ সেন।

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন