মঙ্গলবার, ৩১ জুলাই, ২০১৮

খতনা ( দুই )


     খতনা ( দুই )


     ফেসবুক থেকে            শেয়ার করেছেন            প্রণব কুমার কুণ্ডু


কেনো খতনা করাতে হবে, প্রয়োজনটা কী - 2 ?
আমরা মোটামুটি সবাই সেই লেজ কাটা শেয়ালের গল্পটা জানি, যে অন্যদের লেজ কাটতে গিয়ে বৃদ্ধ শেয়ালের যুক্তির কাছে পরাজিত হয়ে জঙ্গল ছেড়ে পালিয়েছিলো। কিন্তু গল্পটা এখানেই শেষ নয়, ঐ জঙ্গল থেকে পালিয়ে সে অন্য জঙ্গলে গিয়েছিলো এবং কিছু শেয়ালের লেজ কাটতে সক্ষম হয়েছিলো। ১০ জন অসৎ, মিথ্যাবাদী, অসাধু চোর বাটপারদের
মধ্যে আপনি একা যদি পড়েন, তাহলে আপনার সততাই হবে আপনার বিড়ম্বনার কারণ এবং তাদের অনবরত টিটকারির কারণে এক সময় আপনার মনে হবে, না ওরাই ঠিক; এজন্যই বলা হয়, দশচক্রে ভগবান ভূত। বাংলাদেশের এমন কোনো হিন্দু ছেলে নেই, যাকে, খতনা না করা নিয়ে মুসলমানদের টিটকারির শিকার হতে হয় নি। এই শুনতে শুনতে একসময় আমারও
মনে হয়েছিলো, খতনা করাই বোধ হয় ঠিক। কারণ, হিন্দু ডাক্তাররা পর্যন্ত পত্রিকায় আর্টিকেল লিখতো বা এখনও লিখে খতনা করার উপকারিতা সম্পর্কে। তারা নিজেরা খতনা করিয়েছে কি না, তা কিন্তু লিখে না।কিন্তু আর্টিকেলে খতনার উপকারিতা নিয়ে এই কারণে লিখে যে, তাহলে তার লেখাটি পত্রিকার মুসলমান সম্পাদক খুশি হয়ে ছাপবে, আর পত্রিকায় নাম
উঠা নামেই একটা সম্মানের ব্যাপার। কিন্তু হিন্দু সমাজ ও জাতির এমনই দুর্ভাগ্য যে, প্রশ্নের মুখে কোণঠাসা হওয়া হিন্দু ছেলেমেয়েদের মুখে মুসলমানদের প্রশ্নেরযোগ্য ও যুতসই জবাব তুলে দেওয়ার মতো কোনো লোক হিন্দু সমাজে জন্ম নেয় নি। তাই সকল প্রশ্নে হিন্দুদের একটাই জবাব, "জানি না, বাপদাদারা করে আসছে, তাই আমরাও করছি।"
এই কারণেই হিন্দু ছেলেরা, খতনা প্রসঙ্গে, কখনো মুসলমানদের মুখের উপর বলতে পারে নি যে, "তুই ঠিক না, আমিই ঠিক। কারণ, আমি প্রকৃত আর তুই বিকৃত।"
কোনো সম্প্রদায়ের এক নবী যদি কোনো কারণে তার হাতের একটা আঙ্গুল কেটে ফেলতে বাধ্য হয়, আর তার অনুসারীরা সেই সিস্টেম অনুসরণ করে নিজেদের হাতের একটা করে আঙ্গুল কেটে ফেলে, তাহলে আঙ্গুল কাটারা ঠিক ? না, প্রকৃতি আমাকে যেভাবে সৃষ্টি
করেছে, সেটাই ঠিক ? প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণীকে বিশ্ব বিধাতা একদম সঠিক আকৃতি ও ধরণে সৃষ্টি করেছে, এভাবেই তারা প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য বেস্ট। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর লিঙ্গ, তাদের চমড়ার মধ্যে গুটানো থাকে। এই চমড়া ই লিঙ্গের সুরক্ষার কাজ করে। একমাত্র পুরুষ মানুষের লিঙ্গ ই পুরোটা দেহের বাইরে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে, কিন্তু লিঙ্গমনি, যেটার ঘর্ষণে পুরুষ যৌন সুখ লাভ করে, প্রাকৃতিক উপায়েই সেটা চামড়া দ্বারা আবৃত থাকে তার সেনসিভিটি বা
স্পর্শকাতরতা রক্ষার করার জন্য ও আর্দ্র রাখার জন্য।কিন্তু খতনার নামে যখন সেই চামড়া কেটে ফেলা হয়, তখন বছরের পর বছর সেটা উন্মুক্ত থাকার ফলে এবং কাপড়ের সাথে অনবরত ঘর্ষণের ফলে লিঙ্গমনির সেনসিভিটি নষ্ট হয়, এর ফলে খতনা করা ব্যক্তি যৌন সঙ্গমের সময় কখনোই ১০০% সুখপেতে পারে না এবং লিঙ্গমনির সেনসিটিভিটির মাধ্যমে স্ত্রী যোনীর ভেতরেও সেনসিভিটিপ্রবেশ করিয়ে নারীদের যে সুখ দেওয়া যায়,
সেটাও একজন খতনা করা ব্যক্তি ১০০% দিতে পারে না। এর ফলে নারী পুরুষ দুজনেই চরম যৌনসুখ থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ, স্ত্রী যোনির ভেতরে একটি খতনা করা পুরুষাঙ্গের ঘর্ষণ কিছুটাঅনুভূতি হীন নকল পুরুষাঙ্গ ডিলডো বা স্পর্শকাতরতাবিহীন আঙ্গুল চালানোর মতোন।
খতনার উপকারিতা সম্পর্কে যেসব মিথ্যা বাজারে প্রচলিত, এবার সেগুলোর দিকে নজর দেওয়া যাক।খতনা না করলে নাকি যৌন রোগের সংক্রমন ঘটে।পৃথিবীর কোন পুরুষ, যৌন সংগমের পর যৌনাঙ্গ না ধুয়ে ঐ অবস্থায় থাকে এবং তারপর আবার যৌনসঙ্গমে মিলিত হয় ?
খতনা না করালে নাকি চামড়ার নিচে এক ধরণের ময়লা জমে; এখন বলুন, পৃথিবীর কোন ছেলে নিজের লিঙ্গের প্রতি এতটা উদাসীন, যে সে ঐ ময়লা পরিষ্কার করে না বা করবে না ? আর কিশোর বয়সের পর এই ময়লা জমার কি কোনো কারণ আছে ? বিষয়টা বুঝে নেন।
খতনা না করালে নাকি এইডসের ব্যাপক বিস্তার ঘটে।
একমাত্র বহুগামী মুসলমানদের মাথায় এই ধরণের যুক্তি আসা সম্ভব। কারণ, মুসলমানরা তো বহুগামী, ওদের বাড়িতে থাকে ৩/৪টা স্ত্রী। এরপরেও আবাসিক হোটেলে বা পতিতালয়ে মাঝে মাঝে নাগেলে বা কোথাও সুযোগ পেলে, কোপ না মেরে থাকতে পারে না। তাই মুসলমানদেরই এইডস হওয়ার ভয়। হিন্দু ও বৌদ্ধরা খতনা করে না। তাই ভারত ও চীনে কত এইডস রোগী আর আফ্রিকার মুসলিমদেশগুলোতে কত এইডস রোগী, তার পরিসংখ্যানটা একটু জেনে নিয়েন।আফ্রিকার দেশগুলোতে তো আর হিন্দু বৌদ্ধ নেই, সবাই কাটা মুসলমান। তাহলে ওখানে এত এইডস রোগী এলো কোথা থেকে ? ওই সব দেশে এইডসের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে, ঔষধ আবিষ্কার না হলে, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলো জনসংখ্যা শুন্য হয়ে পড়বে।
খতনার পক্ষের আরেকটি ভুয়া সুড়সুড়ি হলো, খতনা করালে নাকি যৌনসঙ্গমের সময় বেশি টাইম পাওয়া যায়। এটা সত্য হলে তো বাংলাদেশের বাজারে, শীঘ্রপতন রোধ করতে বা টাইম বৃদ্ধির কোর্সের এত রমরমা ব্যবসা থাকতো না। কারণ, বাংলাদেশের তো ৯০% ই কাটা মুসলমান। তারা তো কেটেছেই, তাদের আবার টাইম বৃদ্ধির দরকার কী ? আসলে ইসলামের মিথ্যাচারের জবাব দেওয়ার মতো কোনো মিডিয়া বা পরিবেশ তো বাংলাদেশে নেই, তাই এরা এসব বালছাল বলে বার বার পার পেয়ে যায়।
আসল ব্যাপার হলো, সেক্সের সময়, যৌন শক্তি এবং স্থায়িত্ব নির্ভর করে কোনো ব্যক্তির শারীরিকগঠন, তার স্ট্যামিনা এবং কতটা নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে এবং ফুর্তি নিয়ে যৌনসঙ্গম করছে, তার উপর। এখানে কার কাটা আছে, আর কার কাটা নেই, সেটা কোনো ব্যাপার নয়। প্রাপ্ত বয়স্ক অনেকেই জানেন যে,যৌন সঙ্গমের সময় কনডম ব্যবহার করলেই বেশ কিছু সময় বেশি পাওয়া যায়। কনডম ব্যবহার করে অনেক সংক্রামক যৌন রোগ থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। তাহলে খতনা করানোর পক্ষে যেসব যুক্তিদেখানো হয়, দেখা যাচ্ছে, এক কনডম ব্যবহারের ফলেই তো সেগুলো কভার করে যাচ্ছে, তাহলে খতনা করার প্রয়োজনটা কী ?মোট কথা খতনার কোনো উপকারিতা নেই, কিন্তু খতনা করার ফলে কী কী ক্ষতি হতে পারে, এবার সেটা দেখা যাক।
লিঙ্গমনির সঙ্গে লিঙ্গ অগ্রের চামড়া জন্মের পর থেকেই যুক্ত থাকে এবং১০/১২বছর বয়সে সেটা প্রাকৃতিক ভাবেই আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু ম্যাক্সিম্যাম বাচ্চার খতনা করানো হয় ৫ থেকে ৮/৯ বছরের মধ্যে। এই সময় খতনা করাতে গিয়ে অনেক সময়ই চামড়ার সাথে সাথে লিঙ্গমনির কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এই ক্ষতি নিয়েই একজন মানুষকে সারাজীবন চলতে হয়। আমার এক মুসলিম ক্লাসমেট ঠিক মতো কথা বলতে পারতো না, জোরে কথা বলতে গেলেই তার কথা আটকে যেতো। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলেছিলো, "৪ বছর বয়সে তার খতনা করানো হয়, ঐ সময় লিঙ্গের চামড়া কাটতে গিয়ে লিঙ্গমনিতে আঘাত লাগে এবং সে অজ্ঞান হয়ে যায়। ” দেহের মধ্যে সবচেয়ে সেনসিটিভ অঙ্গ হচ্ছে লিঙ্গমনি, সেখানে কোনো প্রকারের আঘাত লাগলে সেটা সাংঘাতিকভাবে আঘাত করে ব্রেইনে এবং ব্রেইন কোনো না কোনো ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আমার ঐ ক্লাসমেটেরও ব্রেইন ঐ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো। পরে ডাক্তারের কাছে গিয়ে তারা এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে জানতে পারে। তাছাড়া খতনা করা লিঙ্গও দেখতে চামড়া ছিলা মুরগীরমতো বিশ্রী, এটা এক মুসলিম মেয়ের মত। এছাড়াও এমন কোনো শিশু নেই যে, সে স্বেচ্ছায় খতনা করাতে চায়, সব সময়ই তার ইচ্ছারবিরুদ্ধে জোর করে তাকে খতনা করানো হয়। আমার আরও এক মুসলিম ক্লাসমেট, তার খতনা করানোর দিনের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলো, যেদিন খতনা করানো হবে, সেদিন সে কাঁদতে কাঁদতে তার বাপের কাছে গিয়ে অভিযোগের সুরে বলেছিলো, "আব্বা, ওরা নাকি আমার নুনু কেটে নিবে ? আমি কাটতে দিমু না, এই অবস্থা সকল বাচ্চারই। ভালো কি মন্দ, তা বুঝে উঠার আগেই কারো কোনো অঙ্গের ক্ষতি করা নিশ্চিতভাবেই মানবাধিকারের লংঘন। শেষে একটা কথা মনে রাখবেন, প্রকৃতি যেভাবে আপনাকে সৃষ্টি করেছে, সেটাই ঠিক। আপনার খতনা করা নেই, এজন্যই আপনি প্রকৃত। আর যাদের খতনা করা হয়েছে তারা বিকৃত। প্রকৃতির সৃষ্টিকে তারা কেটে কুটে তার স্বাভাবিকত্বকে নষ্ট করেছে।
প্রথম ফাঁদে পড়ে খতনা করতে বাধ্য হয়েছিলো নবী ইব্রাহিম, তার পর করানো হয় ইব্রাহিমের পুত্র ইসমাইলকে, এরপর থেকে মুসার অনুসারী ইহুদি এবং যিশুর অনুসারী খ্রিষ্টানরা ধর্মের নামে ধারাবাহিকভাবে খতনা করে আসছে। এই প্রত্যেকটা ধর্ম ভুয়া এই কারণে যে, সৃষ্টিকর্তা তাদের এই প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দিয়ে এখনও খতনাসহ কোনো মানব সন্তানকে পৃথিবীতে পাঠায় নি। যদি তাদের ধর্ম সত্য হতো, তাহলে সৃষ্টিকর্তা বিধাতা খতনাসহ মানব সন্তানের জন্ম পৃথিবীতে দিতো। এখনও খতনা বিহীন মানব সন্তানের জন্ম, এটাই প্রমাণ করে যে, আদি সনাতন মানব হিন্দু ধর্মই পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম এবং এটাই চিরন্তন ও শ্বাশত। আর সকল, মানব সৃষ্ট ধর্ম ব্যক্তিগত, ও ভুয়া।সুতরাং খতনা না করা নিয়ে আর কোনো হীনম্মন্যতা
নয়, বরং আপনার খতনা করা নেই, এটা আপনার গর্বের ব্যাপার; এই জন্য যে, প্রকৃতির সৃষ্টি আপনার কাছে প্রকৃতই আছে, তা বিকৃত হয় নি। আর যা কিছু প্রাকৃতিক, সেটাই তো খাঁটি। তাই নয় কি ?
জয় হিন্দ।

ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কা


    ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কা


     ফেসবুক থেকে         শেয়ার করেছেন           প্রণব কুমার কুণ্ডু


আজ কথা বলব এক বিখ্যাত বীর শহীদের কথা, যার আত্মবলিদানের জন্য নিষ্ঠুরতম হত্যালীলা থেকে বেঁচে যায় আমার শহর- আগরতলা।
সন ১৯৭১। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে চলছে পাকিস্তানিদের দ্বারা বাঙালী নিধনযজ্ঞ। সেই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের হাজারো মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে ভারত। কলকাতা ও আগরতলার বাঙালীদেরও ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে কলকাতা ও আগরতলা, দুই শহরই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এমত পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ১৯৭১ সনের ৩ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে আক্রমণ করে বসে। তাদের গোপন পরিকল্পনা ছিল হঠাৎ করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালালে ভারতের নজর পশ্চিমদিকে চলে যাবে, সেই সুযোগে অতর্কিতে লাগোয়া রাজ্য ত্রিপুরা আক্রমণ করে রাজধানী আগরতলার দখল নেওয়া যাবে। এতে আন্তর্জাতিক স্তরে পাকিস্তানের অবস্থান সুদৃঢ় হবে, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী ভিতকে দুর্বল করে দেওয়া যাবে।
তবে পাকবাহিনীর এই গোপন পরিকল্পনার কথা ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে আগেভাগেই চলে আসে। ভারতীয় গোয়েন্দাবাহিনী জানতে পারে পাক সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা জেলা থেকে আখাউড়া হয়ে আগরতলায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে। তাই কুমিল্লা জেলার গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় অস্থায়ী সেনাশিবির স্থাপন ও বাঙ্কার তৈরি করে জওয়ান মোতায়েন ও অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করে রাখে তারা।
১৯৭১ সালে ৩রা ডিসেম্বর পাকবাহিনী স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে আক্রমণ শুরু করে। ভারতীয় বাহিনী তাদেরকে উপযুক্ত জবাব দেয়। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা এলাকায় পাক সেনাশিবির লক্ষ্য করে ভারতীয় সেনারা পাল্টা আক্রমণ চালায়।
১৪ গার্ড রেজিমেন্টের মেজর ও পি কোহলি'র নেতৃত্বে ভারতীয় সময় রাত ২টায় আলফা ও ব্রাভো এই দুই কোম্পানির সেনা জওয়ান কুমিল্লা সেক্টরের গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) প্রবেশ করে। রেলের দুটি ট্রেক ধরে ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কা ও ল্যান্স নায়েক গোলাব সিং'র নেতৃত্বে দুটি লাইনে ভারতীয় সেনা জওয়ানরা এগিয়ে যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে তাদেরকে নজর রেখে রেল লাইনের নিচের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন মেজর কোহলি।
রাত আড়াইটে নাগাদ ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কার পা পাকবাহিনীর পাতা ফাঁদে লেগে যায়। সঙ্গে সঙ্গে গোটা এলাকা আলোয় আলো জ্বলে ওঠ। ভারতীয় সেনাদের দেখে ফেলে বাঙ্কারে থাকা পাক সেনারা। প্রহরারত এক পাকসেনা চেঁচিয়ে উঠতেই শুরু হয় গুলির লড়াই। বছর আটাশের ল্যান্স নায়েক এক্কা এগিয়ে গিয়ে বাঙ্কারে থাকা পাক বাহিনীর জওয়ানদের খতম করেন। এলবার্ট এক্কা তার সঙ্গী ল্যান্স নায়েক গোলাব সিং, মেজর কোহলি সহ দুই কোম্পানির মোট ২৪০ জন জওয়ান পাকসেনাদের পরাস্ত করে একের পর এক বাঙ্কারের দখল নিতে থাকেন। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে যুদ্ধ করার সময় পাক বাহিনীর ছোড়া একটি গুলি এলবার্ট এক্কা'র বাঁ হাতে লাগে। তারপরও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই অবস্থায় আরো একটি গুলি এসে লাগে এলবার্ট এক্কার গলায়। তিনি মাটিতে পড়ে যান কিন্তু দমে যাননি। উঠে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেন রেলের উচু সিগন্যাল রুম থেকে ভারতীয় সেনা বাহিনীর দিকে গুলি ছুটে আসছে। তখন তিনি সিগন্যাল রুম লক্ষ্য করে উপরের দিকে গ্রেনেড ছোড়েন। গ্রেনেডে একাধিক পাকসেনার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।কিন্তু নিজের ছোড়া গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে গুরুতর জখম হন এলবার্ট এক্কা। তার শরীরের অঙ্গপ্রতঙ্গ বেরিয়ে যায়। এই অবস্থায় তিনি লক্ষ্য করেন, এক পাক সেনা সিগন্যাল রুম থেকে ভারতীয় জওয়ানদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। নিজের ক্ষত স্থান চেপে ধরে লোহার সরু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে শেষ পাক সেনাকে বধ করে নিচে নামার সময় শহীদ হন।
সেই রাতে এলবার্ট এক্কার পাশাপাশি আরো ১১জন ভারতীয় বীর জওয়ান শহীদ হন। এরা হলেন গোলাব সিং, কাশীনাথ সাহু, ডেভিড টিগ্যা, মার্গ গিয়াত সিং, উবাও সিং, রামদেও সাহু, কেশর দেব, দাল সিং, যোসেফ টোপনো, শিব নারায়ণ ও দূর্গা প্রসাদ। সেই রাতে প্রায় সব পাকসেনাকে খতম করতে সক্ষম হয়েছিলেন ভারতীয় বাহিনীর জওয়ানরা। এই অভিযান শেষ হতে হতে দিনের নতুন আলো ফুটে ওঠে।
পরে শহীদ ভারতীয় জওয়ানদের আগরতলার বাধারঘাটের শ্রীপল্লী এলাকায় সমাধিস্ত করা হয়। এখানে একটি স্মৃতিসৌধ বানানো হয়েছে তাদের স্মৃতির উদ্যেশে।
ওই রাতের লড়াইয়ে পাক বাহিনীর মনোবল একেবারে ভেঙ্গে যায়। তারা সম্মুখ সমরে আগরতলা আক্রমণের পরিকল্পনা থেকে পুরোপুরি সরে দাঁড়ায়।পরবর্তীকালে পাকবাহিনী যুদ্ধবিমান ও কামান থেকে গোলা ছুড়ে আগরতলায় ক্ষয়ক্ষতির চেষ্টা করলেও সরাসরি আক্রমণের সাহস করেনি।
অসীম সাহসের জন্য ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কাকে ভারত সরকার সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ সম্মাননা পরমবীর চক্র প্রদান করে। এক্কা'র বাড়ি ভারতের বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজধানী রাঁচী শহরের পাশে গুমলা ব্লক এলাকায়। রাঁচী শহরের একটি জায়গায় এক্কার একটি মূর্তি বসানো আছে। জায়গাটি এলবার্ট এক্কা চক নামে খ্যাত। ভারত সরকার এলবার্ট এক্কার নামে ডাক টিকিটও প্রকাশ করেছে।

লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
মন্তব্য করুন

সোমবার, ৩০ জুলাই, ২০১৮

জানার কথা


     জানার কথা


      ফেসবুক থেকে         শেয়ার করেছেন                প্রণব কুমার কুণ্ডু

হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থে কি হিন্দু বা সনাতন শব্দের উল্লেখ আছে ?
ফটো হিসেবে যেটি পোস্ট করেছি, তার জবাব দেওয়ার আমার এই প্রবন্ধের লক্ষ্য। এখানে আসিফ ইকবাল নামে একজন প্রশ্ন করেছে, “মুসলিমদের ধর্ম গ্রন্থে যেমন উল্লেখ রয়েছে যে তাদের ধর্ম ইসলাম।” তার মানে সে বলেছে মুসলমানদের ধর্ম হলো ইসলাম। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে ইসলাম আবার ধর্ম হলো কবে ? ধর্মের মানে কী এই বাল সাহেব তা জানে ?
মানুষ প্রকৃতির সৃষ্টি, তাই প্রকৃতি নামের ঈশ্বরই সৃষ্টি করে দেয় বা দিয়েছে মানুষের ধর্ম। যেমন- প্রকৃতি সৃষ্টি করে দিয়েছে জল বা লোহার মতো পৃথিবীর সকল পদার্থের ধর্ম। এসব পদার্থের ধর্ম কি কোনো মানুষ সৃষ্টি করতে পারে, না পারবে ?
পারবে না।
তাহলে প্রকৃতি নামক ঈশ্বরের সৃষ্টি, মানুষের ধর্ম, কোনো মানুষ সৃষ্টি করবে কিভাবে ?
মানুষ সৃষ্টি করতে পারে শুধু মত বা পথ, একে বলে ইজম। যেমন- কার্ল মার্কস যে মতবাদের জন্ম দিয়েছে, তাকে বলে মার্ক্সিজম= মার্ক্স +ইজম। এই সূত্রে বুদ্ধ যে মতবাদের জন্ম দিয়েছে, তাকে বলা যেতে পারে বুদ্ধিজম, যীশু খ্রিষ্ট যে মতবাদের জন্ম দিয়েছে, তাকে বলা যেতে পারে খ্রিষ্টিয়জম এবং মুহাম্মদের মতবাদকে বলা যেতে পারে মুহম্মদইজম বা মুহম্মদের মত। কোনোভাবেই মুহম্মদের মত বা পথকে ইসলাম নামের ধর্ম বলা যেতে পারে না।
এরপর সে প্রশ্ন করেছে, “এইরকম হিন্দু ভাইদের ধর্মো গ্রন্থে কি উল্লেখ আছে যে তাদের ধর্ম কি???”
ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে সে হিন্দুদেরকে হিন্দু ভাই হিসেবে উল্লেখ করতো না। কারণ, সে জানেই না যে, শুধু হিন্দুদেরকে নয়, সকল অমুসলিমকে ঘৃণা করাই ইসলামের মূল আদর্শ। কারণ, কোরানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, যারা ইসলাম মানে না তারা নিকৃষ্ট সৃষ্টি, জন্তু জানোয়ারের চেয়েও খারাপ, তাদের সাথে আল্লা ও রসূলের কোনো সম্পর্ক নেই, যেখানে পাবে তাদেরকে হত্যা করো। নিচে দেখে নিন কোরানের এরকম কয়েটি হিংসাত্মক ও ঘৃণা বর্ষনকারী আয়াত-
"হে ঈমানদার লোকেরা, ইহুদি ও ঈসায়ীদের নিজেদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না। তারা নিজেরা পরস্পরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহন করে, তাহলে সে তাদের মধ্যেই গন্য হবে।"- ( কোরান, ৫/৫১)
"হে ঈমানদারগণ, ঈমানদার লোকদের ত্যাগ করে কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি আল্লাহর হাতে নিজেদের বিরুদ্ধে দলিল তুলে দিতে চাও।"- ( কোরান, ৪/১৪৪)
"আমি তোমাদের মধ্যে ও ইহুদিদের মধ্যে কেয়ামত পর্যন্ত শত্রুতা সৃষ্টি করে দিয়েছি।...এরা জমিনে বিপর্যয় সৃষ্টির চেষ্টা করে, কিন্তু আল্লা বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না।" - ( কোরান, ৫/৬৪)
“আল্লাহ মুশরিকদের সাথে সম্পর্কহীন এবং তার রসূলও।” (কোরান, ৯/৩)
“এই কুরআন পরিপূর্ণ হেদায়েতের কিতাব। আর সেই লোকদের জন্য কঠিন যন্ত্রনাদায়ক আযাব রয়েছে, যারা আল্লাহর আয়াতগুলোকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে।” (কোরান, ৪৫/১১)
“একথা একান্তই সত্য যে, বহু সংখ্যক মানুষ ও জ্বীন এমন আছে ,যাদেরকে আমি জাহান্নামের জন্যই পয়দা করেছি।.....তারা আসলে জন্তু জানোয়ারের মতো বরং তা হতেও অধিক বিভ্রান্ত।” ( কোরান, ৭/ ১৭৯)
“তাদের মধ্যে থেকে কাউকে নিজের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যতক্ষণ না সে আল্লাহর পথে হিজরত করে আসবে । আর সে যদি হিজরত না করে, তবে যেখানেই পাবে তাকে ধরবে, তাকে হত্যা করবে এবং তাদের মধ্যে কাউকে নিজের বন্ধু ও সাহায্যকারী রূপে গ্রহন করো না।” (কোরান, ৪/৮৯)
“আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে হতে যারা কুফরী করেছে, তারা নিকৃষ্টতম সৃষ্টি।”- (কোরান, ৯৮/৬)
সুতরাং যে ইসলাম বলছে, অমুসলিমদের ঘৃণা করো, তাদেরকে বন্ধু ও সহায্যকারী হিসেবে নিও না, ইসলামকে স্বীকার না করলে হত্যা করো, সেই ইসলামের অনুসারী এক মুসলমান, হিন্দুদেরকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ভাই ! এরা যে ইসলামের কী বাল জানে বা বোঝে, সেটা এবার চিন্তা করুন। হিন্দুদেরকে ভাই হিসেবে ভাবতে হলে আগে ইসলাম ত্যাগ করে মানুষ হ; তারপর হিন্দুদেরকে ভাই হিসেবে মনে করিস।
যা হোক, এরপর সে লিখেছে, “যদি না থাকে তাহলে কিসের ভিত্তিতে নিজেকে হিন্দু অথবা সনাতনি দাবি করেন????”
তার মানে এই বলদ ধরেই নিয়েছে যে, হিন্দুদের কোনো ধর্মগ্রন্থে সনাতন বা হিন্দু শব্দের উল্লেখ নেই।
সিন্ধু শব্দটিকে সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে না পেরে সিন্ধু নদের তীরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর নাম ‘হিন্দু’ রাখে পারসিক বা বর্তমানের ইরানের লোকজন; আর এই শব্দটিই পরে, বর্তমান মধ্য প্রা্চ্যের লোকজন গ্রহন করে এবং পরে যেহেতু ভারতের লোকজন মধ্যপ্রা্চ্যের মুসলমান শাসক দ্বারা প্রায় হাজার বছর ধরে শাসিত হয়েছে, তাই তারা ভারতের লোকজনকে হিন্দু বলে সম্বোধন করতে করতে সনাতনী আর্যরা এক সময় হিন্দু নামেই পরিচিত হয়ে যায়। এখানে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমার নাম যদি কেউ বিকৃতভাবে উচ্চারণ করে, তার জন্য আমি দায়ী, না ঐ মূর্খরা দায়ী, যারা একটা শব্দকে সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে নি বা পারে না ?
নিশ্চয় ঐ মূর্খরাই দায়ী, যারা কোনো শব্দকে সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। তাই যদি হয়, তাহলে সিন্ধু থেকে হিন্দু হওয়াতে বর্তমানের কোনো হিন্দুর দায় আছে, না দোষ আছে ?
যা হোক, এই শেষ প্রশ্নে ইকবাল সাহেব ধরেই নিয়েছে যে, হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থে হিন্দু বা সনাতন শব্দের উল্লেখ নেই। হিন্দু শব্দের উল্লেখ কোনো হিন্দুধর্মীয় গ্রন্থে থাকা সম্ভব নয়; কারণ, হিন্দু শব্দের আবিষ্কার ও প্রয়োগ, হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থগুলো লিখিত হওয়ার অনেক পরে, এবং পৃথিবীতে ইসলামের প্রাদুর্ভাবের কিছু আগে, যখন পারস্য সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো। কিন্তু সনাতন শব্দের উল্লেখ হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থে আছে কি না, দ্যাখ তার প্রমান-
হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ হলো বেদ, চার বেদের একটি হলো অথর্ব, অথর্ববেদের ১০ম অধ্যায়ের ৮ নং সূক্তের ২১ ও ২২ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে,
"ভোগ্যো ভবদথো অন্নমদদ বহু।
যো দেবমুত্তরাবন্তমুপাসাতৈ সনাতনম।"
"সনাতনমেনমাহুরুতাদ্য স্যাৎ পুনর্ণবঃ।
অহোরাত্রে প্র জায়েতে অন্যো অন্যস্য রূপয়ো"
এছাড়াও গীতা হলো হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ, সেই গ্রন্থের ১১/১৮ নং শ্লোকে বলা আছে,
“ত্বমক্ষরং পরমং বেদিতব্যং ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্।
ত্বমব্যয়ঃ শাশ্বতধর্মগোপ্তা সনাতনস্ত্বং পুরুষো মতো মে।।”
এর অর্থ : তুমি পরম ব্রহ্ম এবং একমাত্র জ্ঞাতব্য। তুমি বিশ্বের পরম আশ্রয়। তুমি অব্যয়, সনাতন ধর্মের রক্ষক এবং সনাতন পরম পুরুষ। এই আমার অভিমত।
দেখ রে মূর্খ, হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থে তাদের ধর্ম যে সনাতন তা উল্লেখ আছে কি না ?

জয় হিন্দ।

জয় শ্রীরাম, জয় শ্রী কৃষ্ণ।
From: Krishna kumar das

💜 জয় হোক সনাতনের 💜



লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্যগুলি

একটা ছবি


একটা ছবি


ফেসবুক থেকে            শেয়ার করেছেন          প্রণব কুমার কুণ্ডু




রবিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৮

পরীক্ষায় ভীত ঈশ্বরচন্দ্রকে রচনা লিখিয়েছেন শিক্ষক মহাশয় ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~


পরীক্ষায় ভীত ঈশ্বরচন্দ্রকে রচনা লিখিয়েছেন শিক্ষক
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~


ফেসবুক থেকে               শেয়ার করেছেন                        প্রণব কুমার কুণ্ডু



Abhik Dey



#পরীক্ষায় ভীত ঈশ্বরচন্দ্রকে রচনা লিখিয়েছেন শিক্ষক মহাশয়
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
#ত্রিশ বছরেরও বেশি সংস্কৃত কলেজে অলঙ্কারশাস্ত্রের শিক্ষক ছিলেন প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ। পরীক্ষার ভয়ে ভীত ঈশ্বরচন্দ্রকে জোর করে রচনা লিখিয়েছেন, জাগিয়েছেন উৎসাহ, আত্মবিশ্বাস। এমন শিক্ষকের সান্নিধ্যেই বিদ্যাসাগর পরে হয়ে উঠেছিলেন ছাত্রদরদি অধ্যক্ষ।

সে দিন সংস্কৃত কলেজে পরীক্ষা। সকাল দশটা বাজতেই ছাত্ররা একে একে ক্লাসে এসে লিখতে শুরু করেছে। তারই মাঝে বেঁটেখাটো পণ্ডিতমশায়ের কৌতূহলী চোখ ঘরের এ দিক ও দিক কাকে যেন বারবার খুঁজছিল। ছাত্রদের মধ্যে এক জন বাদে সকলেই সেখানে উপস্থিত। বিশেষ এই ছাত্রটিকে পণ্ডিতমশাই অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সে জন্যেই তাকে নিয়ে ভাবনা!

ক্লাসে না এলেও ইতিমধ্যেই ছাত্রটি কলেজের অন্য একটি ফাঁকা ঘরে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। অবিলম্বে তিনি ছাত্রটিকে রচনা লেখার পরীক্ষায় বসাতে চাইলেন। কিন্তু জেদি ছেলেটি বেঁকে বসল। সে কিছুতেই পরীক্ষা দেবে না। পণ্ডিতমশাই যতই বোঝানোর চেষ্টা করেন, তার জেদও ততটাই বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে পণ্ডিতমশাই কলেজের অধ্যক্ষ মার্শাল সাহেবের কাছে গিয়ে পুরো ঘটনাটি জানালেন। তার পর ছাত্রটিকে চ্যাংদোলা করে তুলে আনলেন ক্লাসে!

সেই ছাত্রটি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আর পণ্ডিতমশাই অলঙ্কারশাস্ত্রের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ। পরীক্ষায় বসলেও ঈশ্বরচন্দ্র এ বার বিরক্ত হয়েই পণ্ডিতমশাইকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন শুধু শুধু তাকে এই পরীক্ষায় বসালেন তিনি? এর উত্তরে প্রেমচন্দ্র একটু হেসে বললেন, ‘‘যা পারো তাই লেখো, না হলে সাহেব অসন্তুষ্ট হবেন।’’ আসলে সাহেবের নাম করে তিনি নিজের ইচ্ছের কথাই বললেন।

প্রেমচন্দ্র ভাল করেই জানতেন ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতিভার কথা। আর এও জানতেন যে সে কিছু লিখলে সেটা ব্যতিক্রমী হবেই। ঈশ্বরচন্দ্র সে সময় স্মৃতিশ্রেণির ছাত্র হলেও, তখনও অলঙ্কারশ্রেণিতে আসেননি। পণ্ডিতমশাই চেয়েছিলেন কলেজে সকলের সামনে ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতিভা তুলে ধরতে। তবে তাঁর আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও কিছুটা নিরুপায় হয়েই ঈশ্বরচন্দ্রকে পরীক্ষায় রচনা লিখতে বসতে হল। ইতিমধ্যে এগারোটা বেজে গিয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র প্রেমচন্দ্রকে বললেন, সকলে দশটায় লিখতে শুরু করেছে, এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কী-ই বা লিখবেন। বিরক্ত প্রেমচন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রচনার বিষয় ছিল ‘সত্যকথনের মহিমা’। পণ্ডিতমশাই চলে যাওয়ার এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, ঈশ্বরচন্দ্র চুপচাপ বসে আকাশকুসুম ভাবতে লাগলেন। একটি অক্ষরও লিখলেন না। দেখতে দেখতে বারোটা বেজে গেল। প্রেমচন্দ্র সেখানে এসে অবস্থা দেখে প্রচণ্ড রেগে গেলেন। তর্কবাগীশকে দেখে ঈশ্বরচন্দ্র অজুহাত দিলেন, তিনি কী লিখবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। মনে মনে রাগ সংবরণ করে প্রেমচন্দ্র শান্ত ভাবে ছাত্রকে বললেন ‘সত্যং হি নাম’ এই বিষয়ে গদ্য লিখতে শুরু করতে। ঈশ্বরচন্দ্র এ বার ভালমতই বুঝলেন, রচনা না লিখলে সে দিন পণ্ডিতমশায়ের হাত থেকে নিস্তার নেই। দেরি না করে লিখতে শুরু করলেন, এক ঘণ্টার মধ্যে রচনা শেষও করলেন।

সে দিন ঈশ্বরচন্দ্র ভেবেছিলেন, পরীক্ষকরা বুঝি তাঁর রচনা পড়ে পরিহাস করবেন। কিন্তু ঘটনা এই, এই রচনা লিখেই তিনি কলেজে একশো টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রেমচন্দ্রের এত কিছু করার উদ্দেশ্য ছিল— ঈশ্বরচন্দ্রের মন থেকে রচনা লেখার ভয় এবং পরীক্ষার ভীতি কাটানো। আপাতদৃষ্টিতে সামান্য মনে হলেও ঘটনাটিতে ঈশ্বরচন্দ্র এক দিকে যেমন উৎসাহিত হয়েছিলেন, ঠিক তেমনই তাঁর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরের বছরও কলেজের পরীক্ষায় পদ্য লিখে পুরস্কার পেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র।

এমনই এক শিক্ষকের কাছে ঈশ্বরচন্দ্র পেয়েছিলেন অনুপ্রেরণা, জীবনের মূল্যবোধ আর কুসংস্কারমুক্ত চিন্তাধারা। বিদ্যাসাগরের মানসিকতা এবং চারিত্রিক ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার নেপথ্যেও প্রেমচন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অলঙ্কারশ্রেণিতে ঈশ্বরচন্দ্র মাত্র এক বছর পড়েছিলেন। তার মধ্যেই গুরু-শিষ্যের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

তখনও এ দেশে বেশ কিছু পাঠ্য বিষয় বই আকারে ছাপা হয়নি। প্রেমচন্দ্রের হাতে লেখা ‘সাহিত্যদর্পণ’-এর একটি পুঁথি ছিল। ব্যবহারের জন্য সেটি তিনি কলেজেই রেখে দিতেন। ছাত্ররা প্রয়োজন মতো এক-একটি পাতা খুলে বাড়ি নিয়ে যেত। আবার রেখেও দিত। এক দিন পুঁথির পাতা মেলাতে গিয়ে প্রেমচন্দ্র দেখেন, কয়েকটি পাতা নেই। এর পর পরই তিনি পুঁথির পাতা ছাত্রদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া বন্ধ করার নির্দেশ দেন।

কয়েক দিন পরে বিশেষ প্রয়োজনে ঈশ্বরচন্দ্র পুঁথির কয়েকটি পাতা খুলে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন। ভেবেছিলেন কাজ মিটে গেলে আবার সেগুলি যথাস্থানে রেখে দেবেন। কেউ বুঝতেই পারবে না। সে দিন কলেজ থেকে বেরনোর ঠিক আগেই এক পশলা বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট বেশ পিচ্ছিল হয়ে উঠেছিল। রাস্তায় যেতে যেতে আচমকা পা পিছলে ঈশ্বরচন্দ্র কাদায় পড়ে গেলেন। জামাকাপড় তো বটেই, পুঁথির পাতাগুলিও জলে ভিজে গেল। এমন অবস্থায় একটি দোকানে উনুনের পাশে নিজের ভিজে চাদরখানা বিছিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র ভিজে পুঁথির পাতাগুলি শুকোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন।

ঘটনাচক্রে ঠিক সেই সময় প্রেমচন্দ্র ওই জায়গা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। প্রিয় ছাত্রের এমন দশা দেখে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন কী হয়েছে। এমন পরিস্থিতির জন্য ঈশ্বরচন্দ্র মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে পুরো ঘটনা অকপটে পণ্ডিতমশাইকে জানালেন। সব শুনে প্রেমচন্দ্র নিজের গায়ের চাদরটি ঈশ্বরচন্দ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আগে কাপড় বদলাতে, পরে দুঃখ করতে! ঈশ্বরচন্দ্র ইতস্তত করছেন দেখে তিনি একটি ঘোড়ার গাড়ি ডেকে সে দিন তাঁর ছাত্রটিকে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। এমন শিক্ষকের সান্নিধ্যে ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনদর্শন আলোকিত হয়েছিল বলেই পরবর্তী কালে তিনি নিজেও এক জন ছাত্রদরদি শিক্ষক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

এক দিন যে ঈশ্বরচন্দ্রকে তিনি জোর করে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষায় রচনা লিখতে বসিয়েছিলেন, সেই ঈশ্বরচন্দ্র পরবর্তী কালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। তবু দু’জনের কখনও ঘটেনি ব্যক্তিত্বের সংঘাত। ঈশ্বরচন্দ্রের বন্ধু গিরীশ বিদ্যারত্নের পুত্র হরিশ্চন্দ্র কবিরত্ন প্রেমচন্দ্রের ছাত্র ছিলেন। এক বার অলঙ্কারশাস্ত্রের কোনও একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি লিখেছিলেন ‘কাশীস্থিতগবাম্’। যা ব্যাকরণগত ভাবে প্রেমচন্দ্রের ভুল মনে হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত রেগে গিয়ে অধ্যক্ষ ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, ‘‘ঈশ্বর, তুমি বাপু এই সব ছেলেপিলের মাথা খাচ্ছ। বাংলায় সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা লিখে যে কী সর্বনাশ করবে, তা বুঝতে পারছ না। এরা কিছু শিখছে না।’’

মাস্টারমশাইয়ের মুখে সে দিন এমন অভিযোগ শুনে, ঈশ্বরচন্দ্র এতটুকুও রাগ করেননি। বরং তাঁকে শান্ত করে বলেছিলেন, ‘‘আর ভাবনা নেই, পণ্ডিতমশাই! আমি এ বার ব্যাকরণ কৌমুদী লিখেছি, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।’’ এর উত্তরে প্রেমচন্দ্র আরও রেগে গিয়ে বলেছিলেন ‘‘ছাই হবে।’’ ঈশ্বরচন্দ্র সে দিন এতটুকুও বিরক্ত হননি। কারণ তিনি জানতেন, প্রেমচন্দ্রের এমন উক্তি শিক্ষাপ্রণালী সম্পর্কে তাঁর কঠোরতার প্রকাশ মাত্র। ব্যাকরণগত ভাবে কিছু ভুল বললে প্রেমচন্দ্র যেমন রেগে যেতেন, ঠিক তেমনই কারও মধ্যে প্রতিভার আভাস পেলে প্রশংসাও করতেন।

বরাবরই প্রেমচন্দ্র ছিলেন প্রতিবাদী চরিত্রের। লর্ড মেকলে যখন এ দেশে সংস্কৃত শিক্ষা বন্ধ করতে সংস্কৃত কলেজ বন্ধের দাবি করেন, প্রেমচন্দ্র তার প্রতিবাদ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রও জীবনের বিভিন্ন সময়ে পেয়েছিলেন প্রেমচন্দ্রের সাহচর্য। বিদ্যাসাগর আয়োজিত প্রথম বিধবাবিবাহ সভায় তৎকালীন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকদের মধ্যে প্রেমচন্দ্রও উপস্থিত ছিলেন।

প্রেমচন্দ্রের জন্ম ১৮০৬-এ বর্ধমান জেলার রায়না থানার অন্তর্গত শাকনাড়া গ্রামের এক প্রসিদ্ধ পণ্ডিত বংশে। পূর্বপুরুষদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন খ্যাতনামা পণ্ডিত। ছেলেবেলায় তাঁর শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের পাঠশালাতে। পরে বাবার ইচ্ছায় প্রেমচন্দ্র শাকনাড়া থেকে কিছুটা দূরে দুয়াড্ গ্রামে জয়গোপাল তর্কভূষণের টোলে ভর্তি হয়েছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রেমচন্দ্র জয়গোপালের অন্যতম প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন এবং তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন সভায়, অনুষ্ঠানে যাতায়াত শুরু করেন। এর ফলে তাঁর পরিচিতি বৃদ্ধি পায়।

কাব্যের প্রতি প্রেমচন্দ্রের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তেরো-চোদ্দো বছর বয়সেই সহজ সরল ভাষায় কবিতা-গান রচনা করতে পারতেন। এমনকী তিনি কবির দলে গানও বাঁধতেন। সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক হওয়ার পরে নিজের বাড়িতে বিভিন্ন পার্বণ-উৎসব উপলক্ষে কবিগানের আয়োজন করতেন। শোনা যায়, প্রেমচন্দ্রের বাড়ির উৎসবে-অনুষ্ঠানে কবিগানের আসরে ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র সবান্ধব যোগ দিতেন। মাঝে মাঝে কলেজের ছুটিতে তিনি প্রেমচন্দ্রের বাড়িতে এসে পড়াশোনাও করতেন। পুকুরে ছিপ ফেলে মাছও ধরতেন!

১৮২৪-এ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় সংস্কৃত কলেজ। তার ঠিক দু’বছর পরে ১৮২৬-এ বাবার উৎসাহে প্রেমচন্দ্র কলেজে যোগ দেন। সে সময় হোরেস হেম্যান উইলসন কলেজের সেক্রেটারি ছিলেন। প্রথম দিন তিনি শাস্ত্র সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করে প্রেমচন্দ্রকে কবিতা লিখতে বলেন। অল্প সময়ের মধ্যে প্রেমচন্দ্র উইলসন সাহেবের সংস্কৃত ভাষায় অনুরাগ, তাঁর নানা গুণ সম্পর্কে শ্লোক রচনা করেছিলেন। ‘ভবান্ ধন্যঃ শ্রীহোরেস উইলসন সরস্বতী। লক্ষ্মীবাণী চিরদ্বন্দ্বং ভবতৈব নিরাকৃতং।।’ এর অর্থ, হোরেস উইলসন তুমি সরস্বতী, ধন্য তুমি, বুঝলাম আমি। লক্ষ্মী সরস্বতী, দুয়ে শত্রু বারো মাস, একত্র তোমারি গুণে, করিছেন বাস! রচনাটি দেখে উইলসন সাহেব অত্যন্ত খুশি হয়ে অবাক দৃষ্টিতে প্রেমচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

কলেজে কিছু দিনের মধ্যে কবি ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এঁরা দু’জনেই বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য উৎসাহী ছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে যখন ‘সংবাদ প্রভাকর’ সংবাদপত্রটি প্রকাশিত হয়, ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে প্রেমচন্দ্র তার সম্পাদনা করতেন।

প্রেমচন্দ্র ‘পুরুষোত্তম-রাজাবলী’ নামক একটি কাব্য লেখার পাশাপাশি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের টীকা রচনা করেছিলেন। আগে কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’-এর সপ্তম সর্গ পর্যন্ত এ দেশে পাওয়া গেলেও অষ্টম সর্গ সহ সম্পূর্ণ গ্রন্থটি পাওয়া যেত না। কাপ্তেন মার্সেল ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় অষ্টম সর্গ সহ সম্পূর্ণ গ্রন্থটি পাওয়া গেলে প্রেমচন্দ্র এর টীকা রচনা করে ‘কুমারসম্ভব’-এর অষ্টম সর্গ প্রকাশ করেছিলেন। আগে এ দেশে সংস্কৃত নাটকগুলি ছাপা না হওয়ায় সাধারণ মানুষ সেগুলি পড়ার সুযোগ পেতেন না। ১৮৩৯-’৪০ নাগাদ প্রেমচন্দ্রই উদ্যোগী হয়ে মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ প্রথম বাংলা অক্ষরে ছাপিয়েছিলেন।

অধ্যাপনার পাশাপাশি প্রেমচন্দ্র প্রাচীন তাম্রশাসন এবং পাথরের ফলক পাঠোদ্ধার করতে পারতেন। এশিয়াটিক সোসাইটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেমস প্রিন্সেপ পূর্ববঙ্গ, ওডিশা এবং মগধ থেকে উদ্ধার হওয়া সংস্কৃত-মিশ্রিত পালি ভাষার তাম্রশাসন এবং পাথরের ফলক প্রেমচন্দ্রের সাহায্যে পাঠোদ্ধার করে বহু ঐতিহাসিক তথ্য পুনরুদ্ধার করেছিলেন।

শোনা যায়, রাজা রাধাকান্ত দেব কোনও জটিল শাস্ত্রের মীমাংসার সময়ে প্রেমচন্দ্রের মতামত না পেলে সন্তুষ্ট হতেন না। কলেজে প্রেমচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে প্রায় রোজই আসতেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। পাশ্চাত্য নাটক ও কাব্যের প্রতিও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। কলুটোলার শ্রীকৃষ্ণ মল্লিক তাঁর কাছে শ্রীমদ্ভাগবতের পাঠ ও ব্যাখ্যা শুনতে আসতেন। প্রেমচন্দ্রও তাঁর কাছে শেক্‌সপিয়রের কাব্যগুলির ব্যাখ্যা মন দিয়ে শুনতেন এবং দেশীয় নাটকের সঙ্গে তুলনা করতেন।

এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ্য। সেই সময় মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকটি ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। এমন সময় পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহের একান্ত ইচ্ছায় নাটকটি এক বার প্রেমচন্দ্রকে পড়িয়ে নেওয়ার কথা ওঠে। মধুসূদন নাটকটির কয়েকটি ফর্মা এক বন্ধুর হাত দিয়ে প্রেমচন্দ্রের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। যথাসময়ে প্রেমচন্দ্র নাটকটি পড়ে মধুসূদনকে ফেরতও দেন। তবে নাটকটি পড়ে প্রেমচন্দ্র কোনও ভুলত্রুটির উল্লেখ না করায় মধুসূদন অবাক হয়ে সেই বন্ধুর কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন। এই কথাটি যখন প্রেমচন্দ্রের কানে পৌঁছয় তিনি বলেছিলেন, কোনও চিহ্ন রাখতে গেলে, অনেক চিহ্ন থেকে যাবে, তার চেয়ে বরং যেমন আছে তাতে কোনও ক্ষতি নেই। বন্ধুর মুখে প্রেমচন্দ্রের এমন মতামত শুনে মধুসূদন তাঁকে অত্যন্ত দাম্ভিক মনে করেছিলেন। পরে মধুসূদনের সঙ্গে যখন প্রেমচন্দ্রের দেখা হয় তখন মধুসূদন নিজের ভুল বুঝতে পেরে স্বীকার করেছিলেন যে সংস্কৃত ভাষায় অলঙ্কার না পড়ে বাংলায় নাটক লেখায় ত্রুটি হয়েছে।

প্রেমচন্দ্র অহংকারী ছিলেন না। বরং সকলকে সম্মান করতেন। হারা নামে এক ধোপা তাঁর কাপড় কাচত। নিপুণ ভাবে কাজ করলেও কাপড় কেচে ফেরত দিতে সে বড় দেরি করত। আর সেই সঙ্গে দিত নানান অজুহাত। এমনটা বহু বছর ধরে চলতে থাকায় প্রেমচন্দ্র এক সময় বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। এক দিন প্রেমচন্দ্রের বাড়িতে এসে হারা কাপড়ের পুঁটলি সবেমাত্র নামিয়েছে, এমন সময় প্রেমচন্দ্র তাঁর কাজের লোকটিকে বললেন, কাচতে দেওয়া কাপড় গুনে নিয়ে হারাকে বিদায় করে দিতে। কথাটি হারা শুনতে পেয়ে বলেছিল, এ দুনিয়ায় ‘সর্বস্কন্দী’-র হাত থেকে কারও রেহাই নেই। আপন মনে আরও কথা বলছে নিজের মনে, এমন সময় প্রেমচন্দ্র সেখানে এসে হারাকে বললেন, তিনি এই ‘সর্বস্কন্দী’ কথাটির অর্থ বুঝতে পারলেন না।

হারা প্রেমচন্দ্রকে এক তৃষ্ণার্ত ব্রাহ্মণের এক চণ্ডালের সঙ্গে কথোপকথনের কাহিনি শোনাল। সেই চণ্ডাল নিজের পরিচয় দিয়েছিল ‘সর্বস্কন্দী’ বলে। কেননা ব্রাহ্মণ কিংবা দেবতা, সে সকলেরই কাঁধে চাপে। এ বার প্রেমচন্দ্র বুঝলেন, ‘সর্বস্কন্দী’-র অর্থ চণ্ডাল বা রাগ। যা কারও কাঁধে চড়লে মানুষ নিজের যুক্তি, বুদ্ধি, সব কিছু হারিয়ে ফেলে। হারার মুখে এমনটা শুনে প্রেমচন্দ্র এতটুকু রাগ করেননি। বরং হারার গভীর উপলব্ধি ও জ্ঞানের প্রশংসা করে বলেছিলেন, এখন থেকে তিনি হারার শাগরেদ হলেন। হারাকে তিনি ‘ওস্তাদজি’ বলে ডাকতেন।

কর্মসূত্রে প্রেমচন্দ্র দীর্ঘ ৩১ বছর ৯ মাস সংস্কৃত কলেজে অলঙ্কারশাস্ত্রের অধ্যাপনা করার পর অবসর নেন। এর পর কাশীতে চলে যান। সেখানে তিনি প্রায় চার বছর জীবিত ছিলেন। ১৮৬৭-তে কাশীতে প্রেমচন্দ্রের মৃত্যু হয়। জীবনের শেষ সময়ে প্রেমচন্দ্রের স্ত্রী ছাড়া আর কোনও আত্মীয় পাশে ছিল না। তবে ঈশ্বরচন্দ্রের বাবা ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় সে সময় কাশীতে, প্রেমচন্দ্রের শেষশয্যায় ও অন্ত্যেষ্টিতে তিনি উপস্থিত ছিলেন।

পুনশ্চ: প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের কোনও ছবি পাওয়া যায় না। তাঁর পঞ্চম পুরুষ বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি জানিয়েছেন, তাঁদের বাড়িতেও প্রেমচন্দ্রের কোনও ছবি নেই। শিক্ষক দিবসের আগে এ বারেও তাই ছবিহীন থেকে গেলেন বিদ্যাসাগরের মাস্টারমশাই। 🙏🙏🙏

#COLLECTED*