বুধবার, ৬ জুন, ২০১৮

কলকাতায় বৌদ্ধ মঠ 'কারমা গন'



    কলকাতায় বৌদ্ধ মঠ 'কারমা গন'                           শেয়ার করেছেন             প্রণব কুমার কুণ্ডু


"ক্যালকাটা কারমা গন" বৌদ্ধ মঠ।
সিকিমের বিখ্যাত মনাস্ট্রি, তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম, এক অজানা লামার কাহিনী।
-----------------------------------------------------------------------
যে সব বাঙালি সিকিম গেছেন বা যাদের সিকিমের বৌদ্ধ মঠ গুলি সম্পর্কে ধারণা আছে, তারা নিশ্চই জানেন যে "রুমটেক মনাস্ট্রি" হলো সিকিমের এক বিখ্যাত ও প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ। এই মঠেরই কলকাতার শাখা হলো এই "কারমা গন" মঠ।
কিন্তু চক্রবেরিয়া রোডের মত দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত অবাঙালি পাড়ায় কিছু বিলাসবহুল আবাসনের মাঝে কবে, কিভাবে আর কেনই বাহ তৈরি হলো এক বৌদ্ধ মঠ তা জানতে আমাদের ইতিহাসের পাতা উল্টে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় নব্বই বছর।
"কারমা গন" মানে কারমার মঠ। কিন্তু "কারমা" কে?? আম বাঙালির কাছে বৌদ্ধ ধর্ম গুরু বলতে প্রথমেই দলাই লামার কথা মনে পড়ে। কিন্তু দলাই লামা ছাড়াও অনেক ধর্মগুরু আছেন যাদের কথা বাঙালি প্রায় জানেই না। যেমন কর্মপা(karmapa)। আরো বিশদে বলা যাক। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে প্রধানত ছয়টি সম্প্রদায় আছে। এদের মধ্যে কাযু(kagyu) সম্প্রদায় অন্যতম। এই সম্প্রদায়ের লোকেরা কর্মপা কে নিজেদের প্রধান গুরু বলে মনে করেন। সিকিমের রুমটেক মোনাস্ট্রি হলো এই সম্প্রদায়ের লোকেদের প্রধান মঠ কারণ এখানেই কর্মপা বসবাস করেন এবং সম্প্রদায়কে চালনা করেন।
সেটা ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক। স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর তিব্বতের সাথে পড়শি ব্রিটিশ ভারতের যোগাযোগ বাড়ছে। সেই সময় "আক্কা দরজি" নামে এক তিব্বতি লামা দার্জিলিং এ বসবাসকারী কিছু ভুটানি কাযু সম্প্রদায়ের লোকেদের জন্য তৈরি করেন এক মঠ। ক্রমে তা ভুটিয়া বস্তি মঠ নামে পরিচিতি পায়। কিন্তু তিরিশের দশকে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং অলিপুরের কাছে একটি ছোট বৌদ্ধ মঠ করে কলকাতায় বসবাসকারী হিমালয়ের বৌদ্ধ লোকেদের ধৰ্মপিপাসা মেটাতে থাকেন। ক্রমে তা বর্তমান ঠিকানায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু অর্থের ও লোকবলের অভাবে ক্রমেই মাঠটি চালানো কঠিন হয়ে পড়লে সেই কাযু লামাটি নিজেদের মুখ্য কার্যালয়ের শরণাপন্ন হন। অর্থাৎ সিকিমের রুমটেক মোনাস্ট্রির।সেটা ১৯৭০ এর দশক ।
তখুন রুমটেক মোনাস্ট্রির প্রধান ছিলেন ষোড়শ কর্মপা যিনি তখুন সারাবিশ্বে দলাই লামার মতোই খ্যাতি লাভ করেছিলেন তিব্বতের স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করে। রুমটেক মোনাস্ট্রি এই মঠটি অধিগ্রহণ করে এবং ১৯৭৬ এ ষোড়শ কর্মপা নিজে কলকাতার এই উপলক্ষে আসেন। এর নতুন নামকরণ হয় কারমা গন বা কারমার মঠ।
চারতলা মাঠটিতে ঢোকার সময়েই দুইশ্রেণী ধর্মাচক্র বা prayer wheels আপনাকে স্বাগত জানাবে । মূল প্রার্থনা ঘরটি দোতলায়। চারটি বিশাল মূর্তি এখানে পূজিত হয়। একদম ডানদিকে আছে "গুরু রিংপচে" যাকে তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের প্রবক্তা বলা হয়। এর পরে আছে "দোলমা"। এনাকে হিন্দু দেবী সরস্বতী বা তারার রূপ বলে মনে করা হয়। এর পরে আছে "সাংগায়" বা বুদ্ধমূর্তি। সর্বশেষ মূর্তিটি হলো "চেনরেজিগ" যা বুদ্ধের আর এক রূপ বলে তিব্বতিরা মনে করে। এছাড়াও রয়েছে ষোড়শ কর্মপার এক বিশাল মূর্তি। প্রতিদিন দুবেলা প্রার্থনা আর পুজো মঠের লামারা করে থাকেন।
বোধহয় সবচেয়ে সুন্দর জায়গা হলো মঠের ছাদ। ছাদে বৌদ্ধ স্তুপের(stupa) মতো একটা কাঠামো রয়েছে। এর ভিতরে কাঁচের মধ্যে রয়েছে আশীর্বাদরত এক বিশাল বুদ্ধমূর্তি। জায়গাটি দেখে মনে হয় যেন,বুদ্ধ পুরো কলকাতাকে দেখছেন এবং শহরবাসীকে আশীর্বাদ ও বরাভয় প্রদান করছেন। চারদিকে লাগানো রয়েছে ধর্মপতাকা(prayer flags)। এই ধর্মপতাকা গুলো দেখলে মনেই হবে না যে এটা কলকাতার কোনো জায়গা। একমুহূর্তের জন্য হলেও লাদাখ বাহ সিকিমের কোনো মঠের ছবি মনে ভেসে ওঠে।
কলকাতায় বৌদ্ধ মঠ বলতে সকলেই প্রথমে মহাবধি সোসাইটি বা জাপানি বুদ্ধিস্ট প্যাগোডার কথা লোকের মাথায় আসে। অনেকে আবার মায়ানমার বৌদ্ধ মঠের কথাও বলবেন। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম শীর্ষ ধর্মগুরু কর্মপা পদধূলিধন্ন এই মঠের কথা বাঙালি প্রায় জানেই না। বাঙালি সিকিমে গেলে রুমটেক মোনাস্ট্রিকে নিজেদের গন্তব্যে রাখে। কিন্তু কলকাতায় এই মঠেকে বাঙালি জানতে চাইনি। কিন্তু এই মঠ কিন্তু সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে নিজেদের দরজা খুলে রেখেছে। সকাল ১১ টা থেকে বিকেল ৪ টের মধ্যে আপনিও একবার ঘুরে যেতে পারেন। খারাপ লাগবে না।
(তথ্যসূত্র:কারমা গনের সেক্রেটারি শেরেঙ ভুটিয়া, পিটি লামা
ছবি:সোহম চন্দ্র এবং আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ।)


আর

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন