বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৩

পান্নাবাঈ-এর কথা

 পান্নাবাঈ-এর কথা


এই দিনে
6 বছর আগে          ফেসবুক থেকে শেয়ার করা
22 নভেম্বর, 2017 
সবাই-এর সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছে
সবাই




===============
রানা বিক্রমাদিত্য সিংহের অপসারণের ষড়যন্ত্র
=================================
দ্বিতীয়বারের জন্য সিংহাসন লাভ করেও বিন্দুমাত্র বদলালেন না রানা বিক্রমাদিত্য সিংহ। গুজরাটের যবন লুণ্ঠক বাহিনীর আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত চিতোরগড়। নিঃশেষিত চিতোরের নারীকুল। মেবারের এই ঘোর দুঃসময়ে প্রয়োজন ছিল সংযত ও পরিকল্পিত গঠনমূলক কাজে ব্রতী হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত চিতোরকে চিতাভস্ম থেকে পুনঃরজ্জীবিত করা। মেবারের প্রভাবশালী সর্দার ও সভাসদরা ভেবেছিলেন এতবড় ভাগ্য বিপর্যয় থেকে রানা বিক্রমাদিত্য এবারে শিক্ষা গ্রহণ করবেন। নিজের পূর্ববর্তী ভুলত্রুটি সংশোধন করবেন। কিন্তু তাঁদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে দেখা গেল রানা বিক্রমাদিত্য পূর্বের চেয়েও অধিক দুর্বিনীত আর অসংযত হয়ে উঠেছেন।
প্রয়াত মহারানা সংগ্রাম সিংহের শাসনকাল থেকেই করমচাঁদ রাও ছিলেন সংগ্রাম সিংহের এক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মিত্র তথা মেবারের এক উচ্চ প্রভাবশালী সভাসদ ও সর্দার। কর্নেল টডের মেবার গাথায় কথিত আছে জহিরউদ্দিন বাবরের মোগল বাহিনীর বিরুদ্ধে খানুয়ার ঐতিহাসিক যুদ্ধে এই করমচাঁদ রাও মহারানা সংগ্রাম সিংহকে সবধরনের সহায়তা করেছিলেন। খানুয়ার মহাযুদ্ধে পরাজিত ও গুরুতর আহত হন মহারানা সংগ্রাম সিংহ। কৈশোরকালে ভ্রাতা পৃথ্বীরাজ সিংহের অসির আঘাতে মহারানাকে হারাতে হয়েছিল তাঁর একটি চক্ষু। পরবর্তীকালে দিল্লির অন্তিম তুর্কি সুলতান ইব্রাহিম লোধীর (বাবরের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে হুমায়ূনকে পরাজিত করে কিছুকালের জন্য অবশ্য দিল্লির তখত অধিকার করেছিল আরেক তুর্কি শের শাহ সুরি) বিরুদ্ধে যুদ্ধে মহারানা সংগ্রাম হারিয়েছিলেন তাঁর বাম হস্ত এবং বাবরের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক খানুয়ার যুদ্ধে মোগল গোলন্দাজদের নিক্ষিপ্ত কামানের গোলার আঘাতে হতভাগ্য মহারানা সংগ্রাম সিংহের একটি পাও ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। এরপর গুরুতর আহত, রক্তাপ্লুত ও সংজ্ঞাহীন মরনাপন্ন মহারানাকে একটি অশ্বপৃষ্ঠে চড়িয়ে খাউয়ার যুদ্ধভূমি থেকে বহুদূরে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গিয়ে যথাযথ শুশ্রসার মাধ্যামে তাঁকে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরিয়ে আনেন এই করমচাঁদ রাও। অত্যন্ত বিচক্ষণ এবুং দূরদর্শী করমচাঁদ রাও মেবারের এই দুর্দিনে বর্তমান রানা বিক্রমাদিত্যের এহেন ঔধত্বে যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তিনি মনস্থির করলেন যেভাবেই হোক এই ব্যাভিচারী রানাকে তাঁর সিংহাসন থেকে অপসারিত করে মহারানা সংগ্রাম সিংহের কনিষ্ঠ পুত্র কুমার উদয় সিংহকে মেবারের রাজসিংহাসনে বসাতে হবে।
সেইসময় মেবারের এই প্রাজ্ঞ সর্দার করমচাঁদ রাওকে শ্রদ্ধা আর মান্য করতেন চিতোরের রাজসভার সব সদস্যই। এরপর প্রাসাদের গুপ্ত মন্ত্রণাকক্ষে শুরু হল রাজসভার ষড়যন্ত্রকারীদের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। গেম অফ থ্রোন্সের নিয়মানুযায়ী এই বৈঠকে স্থির হল ব্যাভিচারী রানা বিক্রমকে সিংহাসনচ্যুত করে শিশোদিয়া কুলের একমাত্র জীবিত সদস্য কুমার উদয় সিংহকে নতুন রানা হিসাবে ঘোষণা করা হবে। কিন্তু যেহেতু কুমার উদয় সিংহ বর্তমানে একজন নাবালক শিশু অতএব তিনি প্রাপ্ত বয়স্কের অধিকারি না হওয়া পর্যন্ত তাঁর প্রতিনিধি হয়ে রাজ্যশাসন করবেন কোন অভিজ্ঞ ব্যক্তি।
বনবীরের উত্থান আর বিক্রমাদিত্যের অপসারণ
==================================
কিন্তু কে হবে শিশু উদয় সিংহের সেই প্রতিনিধি শাসক। কাউকেই সর্বসম্মতভাবে পছন্দ করা যাচ্ছে না। বহু বাক বিতণ্ডা আর আলাপ আলোচনার পর সকলের নজর পড়ল বনবীরের উপর। সকলে উপস্থিত হলেন বনবীরের নিকটে। মহারানা সংগ্রাম সিংহের ভ্রাতা পৃথ্বীরাজ সিংহের এক সহচরী রমণী ছিলেন শীতলসেনী। তাঁরই গর্ভে বনবীরের জন্ম। রাজসভার জটিল "গেম অফ থ্রোন্স" রাজনীতি থেকে বহুদূরে শান্ত ও সাধারণ জীবনযাপন করতেন বনবীর। দীর্ঘ পেশীবহুল সম্মুনত দৈহিক গঠনের অধিকারি ছিলেন সুপুরুষ বনবীর। সেইসাথে মেবারের অনান্য রাজপুরুষদের ন্যায় অস্ত্র শিক্ষা আর যুদ্ধ বিদ্যাতেও যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন তিনি। তাঁর চেহারায় যেন তাঁর পিতা পৃথ্বীরাজের আদল। একদিকে বনবীর যেমন তাঁর প্রয়াত পিতা পৃথ্বীরাজের মত বীর ও চতুর ছিলেন তেমনি অপরদিকে নিজের মাতার মত সংযত, ভদ্র ও শিষ্টও ছিলেন। এই দুর্দিনে এমন একজন সুপুরুষেরই সন্ধানে রত মেবারের সভাসদরা।
মেবারের সভাসদদের নিকটে কুমার উদয় সিংহের প্রতিনিধি হিসাবে মেবার শাসনের অনুরোধ শুনে প্রথমে সভাসদদের এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না বনবীর। অজুহাত হিসাবে তিনি মার্জিত কণ্ঠে জানালেন যে মেবারের মত রাজ্য পরিচালনা করবার শিক্ষা, সাহস আর দূরদর্শিতা নেই তাঁর। সব শুনে সভাসদরা তাঁকে ভরসা দিয়ে বললেন যে রাজকার্য পরিচালনায় তাঁকে সাধ্যমত যথাযথ সহায়তা করবেন তাঁরা। কিন্তু এরপরেও চতুর বনবীর রাজি হলেন না। তিনি পুনরায় মার্জিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন যে মেবারের প্রজারা শাসক হিসাবে তাঁকে মানবেন কেন ? এর উত্তরে প্রধান সভাসদ ও প্রাজ্ঞ করমচাঁদ বনবীরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, "আপনি বৃথাই এইসব ব্যপারে চিন্তিত হচ্ছেন। আপনি কি বিস্মৃত হয়েছেন যে শিশোদিয়া কুলের রানা পৃথ্বীরাজের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে আপনার ধমনী বেয়ে। চিতোরের এই মহা বিপদের সময়ে আমরা চিতোর তথা মেবারের সভাসদকুল আপনাকে আহ্বান জানাচ্ছি। আপনি কি আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই দুর্দিনে আপনার মাতৃভূমি মেবারের পাশে দাঁড়াবেন না ?" এরপর আর আপত্তি করলেন না ধূর্ত বনবীর।
পরদিন সকালে চিতোরের রাজপ্রাসাদের দরবারকক্ষে আয়োজন করা হল এক বিশেষ রাজসভার। সেই রাজসভায় মেবারের বর্তমান রানা বিক্রমাদিত্যের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগের ফিরিস্তি দিয়ে তাঁকে অবিলম্বে মেবারের বিপর্যয়ের দায় স্বীকার করে সিংহাসন ত্যাগ করতে আদেশ দিলেন প্রধান সভাসদ করমচাঁদ রাও। এরপর করমচাঁদের সমর্থনে রাজসভার অবশিষ্ট সভাসদরাও গলা মেলালে হতবুদ্ধি ও বিস্মিত রানা বিক্রমাদিত্য অনুধাবন করতে পারলেন যে তাঁর দৃষ্টির অন্তরালে ষড়যন্ত্রের জল বহুদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। এখন সবকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রাজসভার একজন সভাসদেরও সমর্থন তাঁর পক্ষে নেই। অতএব হতভাগ্য রানা বিক্রমাদিত্য বাধ্য হলেন বিদ্রোহী সভাসদদের সম্মুখে মাথানত করে মেবারের রাজসিংহাসন ত্যাগ করতে। এরপর অপসারিত বিক্রমাদিত্যকে চিতোরের রাজপ্রাসাদে তাঁর নিজস্ব আবাসেই বসবাস করবার অনুমতি দেওয়া হল। তিনি রাজবৃত্তিভোগী হলেন। সভাসদরা মহা সমারোহে বনবীরকে চিতোরের রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত করলেন।
চিতোরের রাজসিংহাসনে আসীন হতেই গেম অফ থ্রোন্সের নিয়মানুযায়ী নির্লোভ, শান্ত ও সংযত বনবীরের মধ্যেও অতি শীঘ্রই এক বিশাল পরিবর্তন দেখা দিল। বনবীরের স্মৃতির প্রেক্ষাপটে উদয় হল তাঁর কৈশোরকালের একটি ঘটনার কথা। বহুদিন আগে শিশু বনবীরকে নিয়ে তাঁর মাতা শীতলসেনী মেবারের একটি ধর্মীয় মেলায় গিয়েছিল। সেই মেলায় মা আর পুত্রের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল এক ভবিষ্যৎদ্রষ্টা জ্যোতিষী সন্ন্যাসীর। সেই সন্ন্যাসী ছিলেন জন্মান্ধ। তিনি চোখে না দেখতে পেলেও ভক্তদের কপালে তাঁর দক্ষিন হস্তের তর্জনী স্পর্শ করে নিখুঁতভাবে তাঁদের ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারতেন। সেই ত্রিকালদর্শী সন্ন্যাসী শিশু বনবীরের কপালে তর্জনী স্পর্শ করে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে একদিন তিনি মেবারের রাজা হবেন। যদিও সে সময় বনবীরের মাতা সেই সন্ন্যাসীর ভবিষ্যৎবাণী হেসে উড়িয়ে দেবার প্রয়াস করেছিলেন কিন্তু পরবর্তীকালে বনবীরকে বুঝিয়েছিলেন রাজসিংহাসন যেকোন ব্যক্তির পক্ষে কতখানি মারাত্মক ও কণ্টকময় হয়ে উঠতে পারে। হয়তো বনবীরের মা শীতলসেনী নিজের চোখে রানা পৃথ্বীরাজ এবং তাঁর ভাইদের মধ্যে রাজসিংহাসন অধিকার করবার রক্তাত ও ঘৃণ্য রাজনৈতিক খেলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন বলেই সেদিন বালক বনবীরকে সিংহাসন ও ক্ষমতা থেকে দূরে থাকবারই পরামর্শ দিয়েছিলেন। বনবীর মেনেও নিয়েছিলেন নিজের মার এই উপদেশ। কিন্তু আজ নিয়তির অদৃষ্ট পরিহাসে মেবারের বহু কাঙ্ক্ষিত রাজসিংহাসন নিজে থেকে এসেই যখন তাঁর কাছে ধরা দিতে চাইছে তখন কেন সে মাতার আদেশ অমান্য করে রাজসিংহাসন দখল করবার প্রয়াস করবেন না ?
অনেক চিন্তাভাবনা করলেন বনবীর। মনে মনে ভাবলেন যদিও তাঁর মা চিতোরের রাজপরিবারের একজন পরিচারিকা ছিলেন কিন্তু তাঁর পিতা পৃথ্বীরাজ তো মেবারের রানা ছিলেন। অতএব শিশোদিয়া রাজবংশের রক্ত তাঁর ধমনী বেয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুতরাং পৃথ্বীরাজের সন্তান হিসাবে মেবারের রাজসিংহাসনের প্রতি তাঁর দাবিও বিক্রমাদিত্য আর উদয় সিংহের চেয়ে বিন্দুমাত্র কম নয়। কিন্তু এই দুজন জীবিত থাকতে মেবারের রাজসিংহাসন স্থায়ীভাবে লাভ করা দাসিপুত্র বনবীরের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। অতএব সিংহাসনের দাবিদার এই দুজনকে হত্যা করতেই হবে।
বনবীরের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র
================
এরপর হিংস্র শার্দূলের ন্যায় যথাযথ সুযোগের সন্ধানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন বনবীর। অবশেষে একদিন এলো সেই কাঙ্ক্ষিত সুযোগ। এক শুভ দিনে ধাত্রী মা পান্না দাইের হাত ধরে বুঁদির অজ্ঞাতবাস থেকে চিতোরের রজমহলে প্রত্যাবর্তন করল শিশুপুত্র কুমার উদয় সিংহ। তারপর অতিবাহিত হল আরও কয়েকটা দিন। সেদিন ছিল অমাবস্যার এক ঘন আধারছন্ন মধ্য রাত। চিতোরের সমগ্র রাজপ্রাসাদ গভীর নিদ্রায় আছন্ন। ঘন নিকষ আধারের মধ্যে সুবিশাল রাজপ্রাসাদের অলিন্দের কোনে কোনে লাগানো মশাল আর মৃৎ প্রদীপের ক্ষীণ আলোকছটা সেই আধার দূর করা তো দুরস্থান উল্টে যেন সৃষ্টি করেছে আলো-আধারির এক রহস্যময় আদিম পরিবেশ। সেই আলো আধারি মিশ্রিত অলিন্দ দিয়ে আপাদমস্তক কালো পোশাকে পরিবৃত হয়ে নিঃশব্দে চলেছে বনবীর। অলিন্দের মশালের আলোয় তাঁর দক্ষিণ হস্তে ঝকঝক করছে একটি তীক্ষ্ণধার লম্বা ছুরিকা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বনবীর এসে উপস্থিত হল অপসারিত রানা বিক্রমাদিত্যের কক্ষের সম্মুখে। কক্ষের সম্মুখে ভল্ল হাতে প্রহরারত আধা জাগ্রত আর আধা নিদ্রিত দুই রক্ষীকে মুহূর্তের মধ্যেই ছুরিকাঘাতে নিহত করল বনবীর। এরপর কক্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ঘুমন্ত বিক্রমাদিত্যের শয্যার সম্মুখে এসে বনবীর বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে হিমশীতল মস্তিস্কে বিক্রমাদিত্যের বুকে আমূল বিদ্ধ করলেন তাঁর তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা। এর আগে ভাগ্য বারংবার বিক্রমাদিত্যকে সহায়তা করলেও এবারে আর সাহায্য করল না। মুহূর্তের মধ্যে বনবীরের ছুরির মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শে ইহলোকযাত্রা করলেন বিক্রমাদিত্য।
এদিকে এই ঘটনা জানাজানি হতেই চিতোরের রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে কান্না আর হাহাকারের রোল উঠল। কাতর আর্তনাদ আর হাহাকারের শব্দে নিদ্রা ভগ্ন হল মাতৃহীন বালক কুমার উদয় সিংহের ধাত্রী মাতা পান্না বাঈের। ঘুমন্ত উদয় সিংহের শয়নকক্ষের বাইরে ঠিক কি দুর্ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে সেটা প্রথমে আন্দাজ করতে পারলেন না পান্না বাঈ। ঠিক এহেন সময়েই বালক উদয়ের শয়নকক্ষে প্রবেশ করল এক রাজঅন্তঃপুর বাসিনী পরিচারিকা। সে এসে পান্না বাঈকে বনবীরের হত্যালীলার ঘটনার বিবরণ দিল।
বনবীরের কাণ্ড শুনে যারপরনাই চিন্তিত হয়ে পড়লেন পান্না বাঈ। রানা সংগ্রাম সিংহের বাকি পুত্ররা ইতিপূর্বেই খানুয়ার যুদ্ধে বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন। এখন সংগ্রাম সিংহের মেজপুত্র বিক্রমাদিত্যও বনবীরের হাতে নিহিত। শিশোদিয়া রাজবংশের একমাত্র জীবিত সদস্য হলেন শুধুমাত্র বালক কুমার উদয় সিংহ। এদিকে নিজের রাজসিংহাসন নিষ্কণ্টকিট করবার লালসায় বালক উদয়কে হত্যা করবার অভিপ্রায়ে বনবীর হিংস্র শার্দূলের ন্যায় ধেয়ে আসছে কুমার উদয় সিংহের শয়নকক্ষের পানে। চিন্তাভাবনা করবার মত বিন্দুমাত্র সময় অবশিষ্ট নেই। যে করেই হোক কুমার উদয় সিংহের প্রাণ রক্ষা করতেই হবে। শিশোদিয়া রাজকুলের অন্তিম বংশধর উদয়কে বাঁচাতেই হবে। কিন্তু কি ভাবে ?
পান্না দাইয়ের আত্মত্যাগ
==================
এরপর ঘুমন্ত বালক কুমার উদয়ের পানে অসহায়ভাবে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন পান্না বাঈ। তারপরই তাঁর দৃষ্টি চলে গেল উদয়ের পালঙ্কে তাঁরই পাশে নিদ্রিত ফুলের মত নিষ্পাপ আরেকটি শিশুপুত্রের দিকে। এই দ্বিতীয় শিশুটি পান্না দাইয়ের নিজের গর্ভজাত সন্তান। এরপরই কুমার উদয়কে রক্ষা করবার জন্য পান্না দাইয়ের মস্তিস্কে খেলে গেল এমন একটি পরিকল্পনা যার উদাহরণ বিশ্বের ইতিহাসে আর কোথাও পাওয়া যায় না এবং সেই পরিকল্পনাই পরবর্তীকালে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে অমর করেছে পান্না বাইয়ের নাম। পান্না বাঈ দ্রুত একটি মস্ত ফলের ঝুড়ি নিয়ে এসে ঘুমন্ত উদয়কে সেই ঝুড়ির মধ্যে রেখে তাঁর উপর ফল, পুস্প আর পত্র দিয়ে ঢেকে দিয়ে সেই ঝুড়িটি পূর্বের সেই পরিচারিকার হাতে দিয়ে তাকে আদেশ দিয়ে বললেন, "তুমি অবিলম্বে কুমার উদয় সিংহকে নিয়ে চলে যাও বীরা নদীর তীরে। সেখানে পৌঁছে নদীর ঘাটের পাশে আমার আগমনের জন্য অপেক্ষা করো।"
এরপর পান্না নিজের ঘুমন্ত শিশুপুত্রকে কুমার উদয়ের পোশাক আর শিশোদিয়া রাজবংশের আংটি পরিয়ে উদয়ের শয্যায় এনে শুইয়ে দিলো। তারপর নিজের সন্তানকে যুবরাজ উদয়ের চাদর দিয়ে আচ্ছাদিত করে নিজেকে সংযত করবার জন্য এসে দাঁড়ালেন সুবিশাল শয়নকক্ষের উত্তরদিকে অন্ধকারময় এক গবাক্ষের সামনে। ঠিক পর মুহূর্তেই উদয়ের শয়নকক্ষে প্রবেশ করল বনবীর। হাতে তাঁর বিক্রমাদিত্যের রক্তমাখা উদ্ধত ও শাণিত ছোরা। অন্ধকারে নীরবে দণ্ডায়মান পান্নার দিকে তাকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, "উদয় কোথায় ?"
অসহায় পান্না কোনক্রমে নিজের কান্না চেপে ডান হাতের তর্জনী তুলে বিছানায় উদয়ের পোশাক আর আংটি পড়ে ঘুমন্ত নিজের শিশুপুত্রকে দেখিয়ে দিলো। এরপর বনবীর আর দেরি করলেন না। তিনি দ্রুত বিছানার সামনে এগিয়ে এসে নৃশংসভাবে সেই নিদ্রিত নিষ্পাপ শিশুর বুকেও আমূল বিদ্ধ করল ছোরা। একটা অস্ফুট ক্রন্দনধ্বনি করে বার দুয়েক হাতপা ছুঁড়েই স্তব্ধ হয়ে গেল পান্নার সন্তানের নশ্বর দেহ। এরপর কুমার উদয় সিংহকে হত্যা করে নিজের রাজসিংহাসন নিষ্কণ্টকিট হয়েছে মনে করে উৎফুল্ল বনবীর প্রসন্ন চিত্তে উদয়ের শয়নকক্ষ ত্যাগ করলেন।
নিজের চোখের সামনে নিজেরই সন্তানের এহেন মর্মান্তিক মৃত্যু দৃশ্য সহ্য করা কোন মার পক্ষেই সম্ভব নয়। জন্মের সময়কাল থেকে যে শিশুকে তিলতিল করে বড় করেছে আজ নিজের চোখের সামনেই সেই শিশুপুত্রকে বনবীরের ছুরির নির্মম আঘাতে নিহত হতে দেখে নিজের কান্না দমন করতে পারলেন না পান্না দাই। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সংযত করলেন তিনি। পান্নার ভয় হল পাছে তাঁকে অতিরিক্ত কাঁদতে দেখলে যদি সন্দেহের উদ্রেগ হয় ঘাতক বনবীরের মনে। তাই তিনি কোনরকমে নিজেকে সংযত করে মৃত পুত্রের কপালে অন্তিম বারের জন্য একটা স্নেহ চুম্বন অঙ্কিত করে মনে মনে তাঁকে আশীর্বাদ করে বললেন, "হে বীর। নিজের জীবন দিয়ে আজ তুমি তোমার রাজার প্রাণ রক্ষা করেছ। একজন প্রকৃত রাজপুত বীরের মতোই ক্ষত্রিয়ধর্ম পালন করেছ তুমি আজ। একজন রাজপুতের জীবনের শ্রেষ্ঠতম কর্তব্য পালন করেছ তুমি। এবারে তুমি ভানুলোকে গিয়ে চির বিশ্রাম গ্রহণ করো। আশীর্বাদ করি তোমার স্বর্গবাস অক্ষয় হোক।"
আশ্রয়হীন পান্না আর যুবরাজ উদয় সিংহ
==============================
এরপর পান্না রাজমহলের গুপ্তদ্বার দিয়ে ছুটলেন বীরানদীর ঘাটে, যেখানে বালক কুমার উদয় সিংহকে নিয়ে তাঁর আগমনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন রাজঅন্তঃপুরের সেই বিশ্বস্ত পরিচারিকা। সেখানে পৌঁছে পান্না সেই পরিচারিকার সাথে কিছুক্ষণ শলাপরামর্শ করে বালক উদয় সিংহকে নিয়ে প্রথমে উপস্থিত হলেন মেবারের এক সর্দার বাঘজী রাওয়ের ছেলে দেবল রাও সিংহের দরবারে। আশ্রয় প্রার্থনা করলেন তাঁর নিকটে। কিন্তু বনবীরের রোষানলে আক্রান্ত হবার আতঙ্কে দেবল রাও আশ্রয়দান করতে অস্বীকার করলেন পান্না দাই আর বালক উদয় সিংহকে। তবে তিনি পান্নার নিকত প্রতিজ্ঞা করলেন কুমার উদয় সিংহের জীবিত থাকার সংবাদ গোপন রাখবার।
এরপর সেই রাতেই অসহায় আর আশ্রয়হীন পান্না কুমার উদয় সিংহকে নিয়ে রওনা দিলেন দুঙ্গারপুরের সর্দার ঐশকর্ণের নিকটে। সেখানে পৌছলে সব শুনে বনবীরের ভয়ে দুঙ্গারপুরের সর্দারও আশ্রয়দান করলেন না পান্না আর কুমার উদয়কে। এরপর পান্না কুমার উদয়কে নিয়ে উপস্থিত হলেন কুম্ভলগড় পর্বতশীর্ষে অবস্থিত মেবারের দুর্ভেদ্য কেল্লা কমলমীর দুর্গের অধিপতি আশা শাহের কাছে। প্রথমে আশা শাহও তাঁদের আশ্রয়দান করতে অস্বীকার করলেন। এদিকে কুমার উদয়ের আগমনের সংবাদ এসে পৌঁছল দুর্গাধিপতি আশা শাহের মাতার নিকটে। তিনি সব শুনে অবিলম্বে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁর পুত্র আশাকে তিরস্কার করে বলে উঠলেন, "স্বয়ং মেবারের যুবরাজ আজ আশ্রয়প্রার্থী হয়ে এসেছেন তোমার দরবারে। আজ তুমি যে কমলমীর দুর্গের অধিপতি সেটাও সম্ভব হয়েছিল যুবরাজ উদয় সিংহের প্রয়াত পিতা রানা সংগ্রাম সিংহের করুণার ফলে। যুবরাজের পিতাই একদিন তোমাকে এই কেল্লার অধিপতি হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন। আজ তাঁর পুত্রের দুর্দিনে তুমি তাঁকে আশ্রয়দান না করেই ফিরিয়ে দিচ্ছো ? এই তোমার ধর্মবোধ ? এই ধর্মবোধ নিয়ে তুমি নিজেকে একজন জৈন বলে প্রচার করো ? ঠিক আছে আমি আজ এখনই কুমার উদয় সিংহ এবং তাঁর প্রাণ রক্ষাকারী পান্না বাঈকে এই কেল্লায় আশ্রয়দান করছি"
যুবরাজ উদয় সিংহের উত্থান কাহিনী
===========================
এরপর পান্না বাঈ যুবরাজ উদয় সিংহ আর সেই বিশ্বস্ত পরিচারিকা সখীকে নিয়ে কমলমীর দুর্গেই বসবাস করতে শুরু করলেন। দুর্গাধিপতি আশা শাহ যুবরাজ উদয়কে নিজের আপন ভাগ্নে বলে সবার কাছে পরিচিত করলেন। দুর্গের অভ্যন্তরেই আশা শাহের যোদ্ধাদের নিকটে কুমার উদয় সিংহের অস্ত্র ও রাজনীতির শিক্ষাদান শুরু হল। দিন বদলে গেল মাসে, মাস বদলে গেল বছরে। এইভাবেই অতিক্রান্ত হল বেশকিছু বছর। ক্রমে সেদিনের সেই অসহায় ও নিরুপায় যুবরাজ বালক থেকে এক বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী যুবকে পরিণত হলেন। বড় হবার সাথে সাথেই যুবরাজ উদয়ের শারীরিক গঠনের মধ্যে তাঁর প্রয়াত পিতার অবয়বের চিহ্ন আর তেজ স্পষ্ট হয়ে উঠল। একদিন শোনিগুরু সম্প্রদায়ের এক সর্দার আশা শাহর সাথে দেখা করতে এসে যুবরাজ উদয়কে দেখে বিস্মিত হয়ে ফিরে গেলেন। তাঁর কাছ থেকে মহারানা সংগ্রাম সিংহের শারীরিক গঠনের সাথে অদ্ভুত মিলযুক্ত এক অজ্ঞাত পরিচয় বীর যুবকের সংবাদ শুনে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে কৌতূহলী প্রজারা এসে উদয়ের সাথে সাক্ষাৎ করল। এই যুবকই যে যুবরাজ উদয় সিংহ এই বিষয়ে প্রজাদের মনে আর কোন সন্দেহের অবকাশ রইল না। তাঁরা দলে দলে যুবরাজ উদয় সিংহকে মেবারের ভবিষ্যৎ রানা বলে সম্বোধন করে অভিনন্দন জানিয়ে গেল।
(পরবর্তী পর্বে রানা উদয় সিংহের রাজ্যাভিষেক এবং মোগল বাদশাহ জালালউদ্দিন মহম্মদ আকবরের চিতোরগড় অবরোধের কাহিনী)
তথ্যসুত্রঃ ১) Annals and antiquities of Rajasthan, কর্নেল জেমস টড
২) Medieval India: From Sultanat to the Mughals-Delhi Sultanat (1206-1526), শতিশ চন্দ্র
৩) ইন্টারনেট আর উইকিপিডিয়া
৪) ভারত কা বীর পুত্র মহারানা প্রতাপ ধারাবাহিক
#SubhojitRoy #Ban_Padmavati
এই দিনে
6 বছর আগে
22 নভেম্বর, 2017 
সবাই-এর সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছে
সবাই
ফটোর কোনো বিবরণ নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন