মুঘল সালতানাতের গৌরবময় ইতিহাসে স্বমহিমায় দীপ্তিমান সম্রাট আওরঙ্গজেব। তাকে মুঘল বংশের শেষ সফল সম্রাটও বলা যায়। সম্রাট শাহজাহানের চার পুত্রের মধ্যে আওরঙ্গজেব ছিলেন সবচেয়ে চতুর, সমরকুশল ও কূটনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন। তাই পিতার জীবনের সায়াহ্নকালে অমোঘ নিয়তিস্বরুপ উদ্ভূত উত্তরাধিকার যুদ্ধে একে একে সব ভাইকে পথ থেকে সরিয়ে সিংহাসনের চূড়ান্ত উত্তরাধিকার হন আওরঙ্গজেব। কেমন ছিল আওরঙ্গজেবের উত্থানের সময়টি? চলুন জানা যাক সেই সম্পর্কেই।
সম্রাট শাহজাহান যখন দাক্ষিণাত্যের শাসক ছিলেন, সে সময় আহমদাবাদ ও মালব সীমান্তের ধুদে নামক স্থানে ভূমিষ্ঠ হয় তার তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেব। দিনটি ছিল ১৬১৮ সালের ৩ নভেম্বর। নবজাতকের নাম রাখা হয় আবু মুজাফফর মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব। আলমগীর নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। ‘আলমগীর’ নামের অর্থ ‘বিশ্ব বিজেতা’। সময়ের সাথে সাথে নিজের বিজেতা স্বভাবটিও ফুটে উঠতে থাকে তার মধ্যে।
সংঘাতের সূচনা
স্বাভাবিকভাবেই সিংহাসনের প্রতি চার শাহজাদা দারা, সুজা, মুরাদ ও আওরঙ্গজেব সমানভাবে প্রলুদ্ধ ছিলেন। এই চারজনই ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজের গর্ভজাত সন্তান। এরা প্রত্যেকেই পরিশ্রমী ও কুশলী হিসেবে বড় হয়েছিলেন। ১৬৫৭ সালে সম্রাট শাহজাহান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। গুজব রটে যায় যে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। চার পুত্রের মধ্যে শুধু দারা এ সময় পিতার কাছে ছিলেন। এ সময় ভাইদের মধ্যে সবার বড় দারা ছিলেন এলাহাবাদ ও লাহোরের শাসনকর্তা, দ্বিতীয় জন সুজা ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা। আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের এবং সবার ছোট মুরাদ গুজরাট ও মালওয়ার শাসনে নিযুক্ত ছিলেন। সম্রাট শাহজাহানের অসুস্থতাকালে দারা তার কাছে ছিলেন। সবার বড় ও সম্রাটের প্রিয় পুত্র হিসেবে সিংহাসন তার হাতে চলে যেতে পারে এই আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে ওঠেন বাকি ভাইয়েরা।
লক্ষ্য আগ্রা
প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে সুজা ও মুরাদ দু’জনেই নিজ নিজ অঞ্চল থেকে নিজেদের মুঘল সম্রাট বলে ঘোষণা করলেন এবং দু’জনেই সৈন্য নিয়ে আগ্রার দিকে অগ্রসর হলেন। স্থিতধী আওরঙ্গজেব তাড়াহুড়া করলেন না। তিনি নর্মদা নদীর প্রতিটি ঘাটে পাহারা বসালেন এবং বোন রওশন আরা ও অন্যান্য দূত মারফত সকল খবর রাখতে থাকলেন। প্রত্যেক ভাইয়ের প্রতি পদক্ষেপের খবর যাচাই করে নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ ভাবতে থাকলেন আওরঙ্গজেব। পুত্ররা সসৈন্যে রাজধানীর দিকে অগ্রসর হওয়ার সংবাদ বৃদ্ধ শাহজাহানের নিকটও পৌঁছে গেল। তিনি সুজাকে প্রতিহত করার জন্য দারার পুত্র সুলায়মানকে সৈন্য দিয়ে প্রেরণ করেন। সুলায়মানের সঙ্গী হন আম্বরের রাজা জয় সিং। এই মিলিত বাহিনীর সাথে বাহাদুরপুরের যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হন সুজা। জয় সিং তাকে বাংলার সীমানা পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যান।
আওরঙ্গজেব আগ্রার উদ্দেশ্যে আওরঙ্গাবাদ থেকে রওনা হয়ে বুরহানপুরে আসেন। সেখানে কিছুকাল অবস্থান করে নর্মদা নদী পার হয়ে তিনি দিপালপুর আসেন। সেখানে মুরাদের বাহিনীর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। স্বার্থসিদ্ধির জন্য আওরঙ্গজেব চুক্তি করেন মুরাদের সাথে। সিদ্ধান্ত হয় দু’জন একজোট হয়ে দারা ও সুজার বিরুদ্ধে লড়বেন। জয়ী হলে উভয়ে সমানভাগে সাম্রাজ্য ভাগ করে নেবেন। এই চুক্তি ছিল আওরঙ্গজেবের কূটনীতির প্রথম সাফল্য। এর মাধ্যমে তিনি সাময়িকভাবে একজন বিরোধী কম করে ফেলেন। দুই শাহজাদার মিলিত বাহিনী অগ্রসর হলো আগ্রার দিকে।
ধর্মাতের যুদ্ধ
মুরাদ ও আওরঙ্গজেবের মিলিত বাহিনীকে প্রতিহত করতে দারা যোধপুরের অধিপতি যশবন্ত সিংকে পাঠান, সাথে সহযোগিতার জন্য কাশিম খানের নেতৃত্বে একটি বাহিনী যায়। এই দু’জনের নেতৃত্বে যথেষ্ট সমন্বয়হীনতা ছিল। আওরঙ্গজেব যশবন্ত সিংকে চিঠিতে লিখে পাঠান যে, আর কোনো উদ্দেশ্য নয়, অসুস্থ পিতাকে দেখতেই তিনি আগ্রাতে যাচ্ছেন। কিন্তু এ অজুহাত উপেক্ষা করে যশবন্ত তার সৈন্য নিয়ে বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্যে এগোতে থাকেন। অতঃপর ১৬৫৮ সালের ২৫ এপ্রিল ধর্মাত নামক স্থানে দুই দলে প্রচন্ড যুদ্ধ বাধে। দুই শাহজাদার সুসংগঠিত বাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা, আর তার সাথে আওরঙ্গজেবের সুনিপুণ রণকৌশলের কাছে প্রাণপণ যুদ্ধ করেও হার মানতে হয় যশবন্তের রাজপুত সেনাকে। আহত হয়ে যশোবন্ত সিং পালিয়ে যোধপুর পৌঁছান। কথিত আছে, তার রানী তার মুখের উপর দুর্গের তোরণ বন্ধ করে দেন, কারণ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলাতক সেনাপতিকে নাকি রাজপুতরা ক্ষমা করে না। কাশিম খানের অধীনস্থ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকেও আওরঙ্গজেব নিজের দলে টেনে নিয়েছিলেন। ফলে প্রতিপক্ষ আরও দুর্বল হয়ে হারতে বাধ্য হয়। ধর্মাতের এই যুদ্ধে বিজয় আওরঙ্গজেবের দাপট অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়।
সামুগড়ের যুদ্ধ
ধর্মাতের যুদ্ধে জয়লাভ করে আওরঙ্গজেব যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি ফতেহাবাদ নামে একটি শহরের পত্তন করেন। তারপর শক্তিশালী এক বাহিনী নিয়ে তিনি চম্বল অতিক্রম করে সামুগড়ে পৌঁছান। আগ্রা থেকে এটি ছিল আট মাইল পূর্বে। এবার দারা পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে স্বয়ং সামুগড়ে পৌঁছান। ২৯ মে ১৬৫৮, সংঘটিত হয় সামুগড়ের যুদ্ধ। দারা হাতির পিঠে চেপে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত তার সৈন্যদের মধ্যে ঐক্যের অভাব ছিল যথেষ্ট। দারার রাজপুত বাহিনীর হাতে নাজেহাল হয়ে পিছু হটে মুরাদের বাহিনী। রাজপুতদের বীরত্বে অভিভূত হন আওরঙ্গজেব। তবে শেষ পর্যন্ত তার হাতেই রাজপুত বাহিনী ধরাশায়ী হয়। ওদিকে দারার দুই সেনাপতি খলিলুল্লাহ খান ও রুস্তম খান, দু’জনেই নাজেহাল হয়ে পড়েন। দারার গোলন্দাজদের গোলা শেষ হয়ে এলে আওরঙ্গজেবের ইউরোপিয়ান গোলন্দাজ বাহিনী লাগাতার গোলা ছুঁড়ে পরিস্থিতি আরও বেসামাল করে দেয়। এদিকে রুস্তম খান নিহত হলে দারা অবস্থার গুরুত্ব বুঝে হাতি থেকে নেমে ঘোড়ায় চাপেন। কিন্তু তার বাহিনী তাকে হাতির পিঠে না দেখে ভাবে তিনি বুঝি নিহত হয়েছেন। ফলে নিমিষেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে দারার সেনাদল। এই যুদ্ধে দারার প্রায় দশ হাজার সৈন্য নিহত হয়। দারা সহচর ও পরিবার পরিজন নিয়ে দিল্লী পালিয়ে যান।
আগ্রা প্রবেশ
বিজয়ী আওরঙ্গজেব ও মুরাদ আগ্রায় উপস্থিত হন। সম্রাট শাহজাহান আওরঙ্গজেবকে দেখা করার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু সতর্ক আওরঙ্গজেব সাক্ষাৎ থেকে বিরত থাকেন। তিনি দুর্গের ভেতরে যমুনার পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেন। অতঃপর জাহানারার মধ্যস্থতায় শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের সাক্ষাৎ হয়। সম্রাট জানান, এসব যুদ্ধের জন্য তিনি দায়ী নন, বরং দারাই তাকে বাধ্য করেছিল। আওরঙ্গজেব পিতার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে ফেরার পথে তার বিশ্বস্ত অনুচরদের কাছ থেকে শাহজাহানের লেখা একটি পত্র পান। এতে সম্রাটের দারাকে গোপন সহযোগিতা করার কথা ছিল। আওরঙ্গজেব বৃদ্ধ সম্রাটকে গৃহবন্দী করেন। শেষ বয়সে দাপুটে সম্রাট শাহজাহান পুত্রের কাছে নজরবন্দী হয়ে অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ দিন কাটাতে থাকেন। কন্যা জাহানারাও তার সাথে স্বেচ্ছাবন্দীত্ব বরণ করেন। আগ্রার দায়িত্ব পুত্র মোহাম্মদের হাতে দিয়ে আওরঙ্গজেব দিল্লীর দিকে রওনা দেন।
মুরাদের পরিণতি
এদিকে তলে তলে মুরাদ আরও সৈন্য সংগ্রহ করতে থাকেন। প্রয়োজন শেষে মুরাদকেও পথে থেকে সরানো দরকার ছিল। তাই দিল্লী যাত্রার পথে আওরঙ্গজেব মথুরায় যাত্রা বিরতিকালে মুরাদকে নৈশভোজের জন্য শিবিরে আমন্ত্রণ জানান। মুরাদ তার এক সহচরের পরামর্শে নৈশোভোজে যোগ দেন। উল্লেখ্য, এই সহচরকে আগেই অর্থ দিয়ে বশীভূত করে নিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। ভোজে মুরাদকে প্রচুর মদ খাওয়ানো হয় এবং তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লে একজন পরিচারিকা দিয়ে তাকে তাঁবুতে পাঠানো হয়। ক্লান্ত, মাতাল মুরাদ শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়লে তার কোষ থেকে তরবারি বের করে নেয় সেই পরিচারিকা। এভাবে খুব সহজেই বন্দী হয়ে যান মুরাদ। তাকে প্রথমে দিল্লীর দুর্গে বন্দী রাখা হয়েছিল, পরে গোয়ালিয়রের দুর্গে পাঠানো হয়। সেখানে গুজরাটের দিউয়ান আলী নকীকে হত্যার অপরাধে কাজীর বিচারে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। ১৬৬১ সালের ৪ ডিসেম্বর মুরাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
দারার পরিণতি
মুরাদকে পথ থেকে সরানোর পর আওরঙ্গজেব যথেষ্ট নিশ্চিন্তে দিল্লীর দিকে যাত্রা করেন। এদিকে দারা দিল্লীতে যথেষ্ট সৈন্য সংগ্রহ করে নিজেকে শক্তিশালী করতে পারেননি। সংঘাত এড়াতে তিনি লাহোর পালিয়ে যান। আওরঙ্গজেব নির্বিঘ্নে দিল্লী দখল করে নিয়ে ১৬৫৮ সালের ২১ জুলাই নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন এবং ‘আলমগীর’ নাম ধারণ করেন। এরপর আওরঙ্গজেব নিজেকে পুরোপুরি নিষ্কন্টক করতে চাইলেন। তিনি দু’দিকে দু’টি বাহিনী প্রেরণ করলেন। একটি বাহিনী দারার পেছনে লাহোরের দিকে গেল, আরেক বাহিনী গেল এলাহাবাদের দিকে। সেখানে দারার পুত্র সুলায়মান ও আরেক ভাই শাহ সুজাকে দমন করার দায়িত্ব পেয়েছিল তারা।
দারা বিপদ বুঝে লাহোর ছেড়ে গুজরাটের দিকে পালালেন। আহমেদাবাদের শাসক তাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। তার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়ে দারা সৈন্য সংগ্রহ করে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। পূর্বের আজ্ঞাবহ মহারাজ যশবন্ত সিং এসময় তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজমীরে আহবান জানান। কিন্তু যশবন্ত সিংও গোপনে বিজয়ী সম্রাট আওরঙ্গজেবের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। আজমীরের নিকট দেওয়াইয়ের গিরিপথে আওরঙ্গজেবের সৈন্যের সাথে দারার তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দারা পুনরায় আহমেদাবাদে ফিরে আসেন। কিন্তু এবার সেখানকার শাসনকর্তা তাকে শহরে ঢুকতে বাধা দেন। বিজয়ের পতাকা কোনদিকে সমুচ্চ থাকবে, তা তিনি নিশ্চিত বুঝে গিয়েছিলেন। ভাগ্যবিড়ম্বিত দারা এবার আফগানিস্তানের পথে অগ্রসর হলেন। পথে দাদার নামক স্থানে মালিক জিওয়ান নামে এক বেলুচ সর্দারের কাছে তিনি আশ্রয় লাভ করেন। এই সর্দারকে একবার শাহজাহানের রোষানল থেকে রক্ষা করেছিলেন দারা। দারার স্ত্রী নাদিরা বেগমও তার সঙ্গী হয়ে এ পথে চলছিলেন। পথের ক্লান্তি, ধকল সহ্য করতে না পেরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ও দাদারেই মৃত্যুবরণ করেন। তার দেহ সমাধিস্থ করার জন্য লাহোর পাঠিয়ে দেয়া হয়। এদিকে বিশ্বস্ত মালিক জিওয়ান দারার সাথে বিস্বাসঘাতকতা করে বসেন। তাকে তুলে দেন আওরঙ্গজেবের সেনাদের হাতে। দারা ও তার দ্বিতীয় পুত্র সিপহির শিকোহকে দিল্লীতে নিয়ে আসা হয়। আওরঙ্গজেব তাদের চূড়াবত অপমান করার সিদ্ধান্ত নেন। পিতা ও পুত্রকে একটি রুগ্ন হাতির পিঠে বসিয়ে দিল্লীর রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয়। ফরাসি পর্যটক ফ্রান্সিস বার্ণিয়ে এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বর্ণনা দেন। অবশেষে দারাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। সভাসদগণ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন তার বিচার নিয়ে। দানিশমন্দ খান দারার প্রাণভিক্ষার আবেদন জানান। কিন্তু শায়েস্তা খান ও আপন বোন রওশন আরা দারাকে নাস্তিক সাব্যস্ত করে তার মৃত্যুদন্ড প্রার্থনা করেন। আলেম-উলামাগণও মৃত্যুদন্ডের পক্ষে রায় দেন। আওরঙ্গজেবেরও সেরকমই ইচ্ছা ছিল। দারা ও তার পুত্র সিপহির দু’জনকেই মৃত্যুদন্ড দিয়ে পথের সবচেয়ে কাঁটাটি অপসারণ করেন আওরঙ্গজেব। ওদিকে দারার বড় ছেলে সুলায়মানকে পাহাড়ওয়াল থেকে আটক করা হয়। তাকেও প্রথমে দিল্লীতে ও পরে গোয়ালিয়রের দুর্গে বন্দী রাখা হয়। পরে সেখানেই বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যা করা হয়।
সুজার পরিণতি
উত্তরাধিকার সংগ্রামে শাহ সুজা ছিলেন আওরঙ্গজেবের শেষ প্রতিদ্বন্দ্বী। এই দ্বন্দ্বের শুরুতেই সম্রাট শাহজাহানের আদেশে দারার পুত্র সুলায়মান শাহ সুজাকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। ১৬৫৮ সালের মে মাসে সুলায়মানের সাথে সুজার একটি সন্ধি হয়। শর্তানুযায়ী সুজাকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শাসনক্ষমতা দেয়া হয়। আওরঙ্গজেব দিল্লীর সিংহাসনে বসার পর সুজাকে তার পদে অধিষ্ঠিত রাখার আশ্বাস দান করেন। কিন্তু সুজা তাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। তিনি যুদ্ধ করারই সিদ্ধান্ত নেন। ১৬৫৯ সালে উত্তর প্রদেশের খাজুয়া নামক স্থানে তাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে অনিবার্যভাবে সুজার পরাজয় ঘটে। তিনি প্রথমে বাংলা ও পরে আরাকান পালিয়ে যান। আরাকানের মগ রাজা তাকে প্রথমে সাদরে গ্রহণ করলেও পরে তাদের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। অবশেষে ভাগ্যবিড়ম্বিত সুজা আরাকানের মগদের হাতে নিহত হন।
এভাবেই ছল, বল ও কৌশলের সুচারু প্রয়োগ ও সময়ের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে, নিজের বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা কাজে লাগিয়ে আওরঙ্গজেব ভারতবর্ষের একচ্ছত্র সম্রাট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই সংগ্রাম নিঃসন্দেহে নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতামূলক, কিন্তু ক্ষমতার জন্য যেকোনো সীমা লঙ্ঘণ করা মুঘল বংশের রক্তে ছিল। উল্লেখ্য, সম্রাট শাহজাহানও তার যৌবনে পিতা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, জাহাঙ্গীর করেছিলেন তার পিতা আকবরের বিরুদ্ধে। কিন্তু আওরঙ্গজেবের সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি ছিল এবং প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিলেন যথেষ্ট দক্ষ। তাই বলা যায় প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদকে সার্থক প্রমাণ করেই আওরঙ্গজেব নিজেকে তুলনামূলক যোগ্যতর হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং সম্রাট পদবীটি অর্জন করেন। উত্থান হয় এক নতুন সম্রাটের, যে শুধু বংশসূত্রে নয় কর্মসূত্রেও সম্রাট।
তথ্যসূত্র: ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস- মধ্যযুগঃ মোগল পর্ব- এ কে এম শাহনেওয়াজ (pub-2015, p 149-155)
Feature Image: twasul.info
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন