বাংলাদেশে রেলওয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ পর্ব):
শেয়ার করেছেন :- প্রণব কুমার কুণ্ডূ
রেলওয়ে স্থলপথের সবচেয়ে দ্রুততম এবং যাত্রীবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থা। তা-ই বলে রেলের সেবা শুধুমাত্র স্থলেই সীমাবদ্ধ ছিল না। রেল পরিসেবা বিস্তৃত ছিল জলপথ তথা নদীতেও। বাংলাদেশের সর্বত্রই জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র নদী। তাই নদীমাতৃক বাংলায় রেলপথ নির্মিত হলেও তা ছিল অসংখ্য নদী দ্বারা খণ্ডিত। ব্রিটিশ রেল কোম্পানিগুলোর পক্ষে সব জায়গায় সেতু নির্মাণ করা সম্ভব ছিল না, কারণ এই কোম্পানিগুলো ছিল ব্যবসায়িক বা লাভজনক প্রতিষ্ঠান।
যেসব রুট বেশ লাভজনক ছিল, সেখানে রেলসেতু নির্মিত হয়েছে, আর বাকিগুলো ফেরি কিংবা স্টিমার দ্বারা পরিচালনা করা হয়েছে। আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু রেলওয়ের নৌসেবা। ব্রিটিশ রেলওয়েতে নৌসেবা রেলওয়ে ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ব্রিটিশ বাংলার রেল পরিসেবা রেলপথ, রেলস্টেশন, ওয়াগন আর লোকোমোটিভের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং ব্রিটিশ রেলওয়ে ছিল রেলপথ, রেলস্টেশন, লোকোমোটিভ, ওয়াগন, ফেরি, স্টিমার, আর ফেরিঘাট নিয়ে।
বিংশ শতকের প্রথমার্ধেই বাংলায় রেলওয়ের মেরিন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। লর্ড বারিংটন নামে এক ইংরেজ কর্মকর্তা মেরিন বিভাগের প্রথম সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন। আজ আমরা বাংলার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রেল ফেরিঘাট এবং রেলওয়ের নৌরুট সম্পর্কে জানব।
বালাসী ঘাট-বাহাদুরাবাদ ঘাট
বাংলাদেশে মোট দুটি রেলওয়ে ফেরিঘাট ছিল। এর মধ্যে বালাসী-বাহাদুরাবাদ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। বাহাদুরাবাদ বাংলার রেল ইতিহাসে অতি পরিচিত নাম। জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় যমুনা নদীর পাড়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট স্টেশন অবস্থিত। অপরদিকে বালাসী ঘাটের অবস্থান গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলায়। যদিও আগে ফেরি চলত তিস্তামুখ ঘাট পর্যন্ত, কিন্তু ১৯৮৮ সালে যমুনায় নাব্যতা সংকটের কারণে ফেরি চলাচল শুরু হয় বাহাদুরাবাদ থেকে ফুলছড়ি ঘাট পর্যন্ত। কয়েক বছর পর পুনরায় নাব্যতা সংকট দেখা দিলে স্টেশনটি বালাসী ঘাটে স্থানান্তর করা হয়।
নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ কার্যক্রম সমাপ্ত হয় ১৮৮৫ সালে। ১৮৯৪ সালে এ রেলপথ নিয়ে যাওয়া হয় জামালপুর পর্যন্ত। এরপর ১৮৯৯ সালে এই রেলপথ সরিষাবাড়ী উপজেলার জগন্নাথগঞ্জ পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়। ক্রমবর্ধমান যাত্রীচাপ সামাল দিতে ১৯১২ সালে জামালপুরকে জংশন করে একটি লাইন নিয়ে যাওয়া হয় বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত। ঠিক সে সময়ই নির্মিত হয় বাহাদুরাবাদ ঘাট রেলওয়ে স্টেশন। এদিকে যমুনার অপর পাড়ে ব্রহ্মপুত্র-সুলতানপুর রেলওয়ে কোম্পানির অধীনে সান্তাহার থেকে তিস্তামুখ ঘাট পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হয় ১৯০০ সালে। উভয় রেলপথ ছিল মিটারগেজ (১,০০০ মি.মি.)।
সেসময় কলকাতা, পশ্চিমবাংলা এবং উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর সাথে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য বাহাদুরাবাদ ঘাট বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, তখন উত্তরবঙ্গের সাথে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, চট্রগ্রাম এবং ঢাকার রেলপথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল এই বাহাদুরাবাদ ঘাট। ওদিকে মিটারগেজ ট্রেনে করে যাত্রীরা এসে নামত তিস্তামুখ ঘাটে। স্টিমারে করে যমুনা পার হয়ে চলে আসত বাহাদুরাবাদ ঘাটে। সেখান থেকে আবার ট্রেনে উঠে সহজেই ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও ঢাকাতে চলে আসতে পারত। তখনও বাহাদুরাবাদ ঘাটে ট্রেন ফেরি চালু হয়নি।
প্রয়োজনীয়তার তাগিদে এবং ব্যবসায়িক দিক বিবেচনায় ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ সরকার আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের অধীনে তিস্তামুখ ঘাট থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাটে ফেরি চালু করে। সরাসরি ফেরিতে করে যমুনা পাড়ি দিত ট্রেন। অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, এত বড় ট্রেন কীভাবে ফেরিতে উঠত? আসলে বাংলাদেশে এত বড় ফেরি ছিল না, যাতে সম্পূর্ণ ট্রেনটি উঠতে পারে। ওই সময় ফেরিতে মোট ১৩টি লাইন ছিল। আর প্রত্যেকটা লাইনে তিনটি করে বগি বা ওয়াগন ওঠানো যেত। অর্থাৎ, ট্রেনের বগিগুলো খুলে খুলে আলাদা করে ফেলা হতো।
আর এই আশ্চর্যজনক ঘটনা বাহাদুরাবাদকে এনে দেয় জনপ্রিয়তা এবং খ্যাতি। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষের মধ্যে বাহাদুরাবাদ ছিল অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্থান। কালের বিবর্তনে আজ বাহাদুরাবাদ হারিয়ে গেছে। একসময় এই ঘাটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল শত শত হোটেল, দোকানপাট এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ঢাকামুখী যাত্রীদের পদচারণায় সার্বক্ষণিক মুখরিত থাকত এ অঞ্চল। মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে বাহাদুরাবাদ তার জৌলুস হারিয়েছে। আজ আর বাহাদুরাবাদে ট্রেন যায় না।
এখনও অতীতের বহু স্মৃতি আগলে রয়েছে বাহাদুরাবাদ ঘাট। বাহাদুরাবাদের ধ্বংসস্তুপ, সেই ফেরি ঘাট আজও তাকিয়ে থাকে। নদীর স্রোত বয়ে যায়। ভাঙা-গড়ার খেলায় জোয়ার-ভাটার স্রোত বয়ে যায়, কিন্তু ফেরিতে কারও পা পড়ে না। ২০০৪ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর উপর দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হলে ঘাটটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে দেওয়ানগঞ্জ পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করে।
সিরাজগঞ্জ ঘাট- জগন্নাথগঞ্জ ঘাট
জগন্নাথগঞ্জ ঘাট রেলওয়ে স্টেশন নির্মিত হয় ১৮৯৯ সালে। জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলায় যমুনার পারে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট রেলওয়ে স্টেশনের অবস্থান। এ লাইন জামালপুর-ময়মনসিংহ-ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথের সাথে সংযুক্ত। এদিকে যমুনা নদীর অপর পাড়ে ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হয় ১৯১৫-১৬ সালে। সে সময় সিরাজগঞ্জ ঘাট থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত রেলওয়ে পরিচালিত স্টিমারে করে যাত্রী পারাপারের ব্যবস্থা ছিল।
পরবর্তী সময়ে সিরাজগঞ্জ ঘাট থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত রেলওয়ে ফেরি সার্ভিস চালু করা হয়। বালাসী-বাহাদুরাবাদের মতো এখানেও রেলওয়ে ফেরিতে করে বগি এবং মালগাড়ি পারাপার করা হতো। অখণ্ড ভারতবর্ষের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিস্থাপনের জন্য বাহাদুরাবাদ এবং জগন্নাথগঞ্জ ঘাট ছিল অতি পরিচিত নাম। পশ্চিমবঙ্গ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া এবং এদিকে ঢাকা, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম এবং সিলেট, গুয়াহাটি এবং বার্মার সাথে রেলপথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল জগন্নাথগঞ্জ এবং বাহাদুরাবাদ ঘাট। সেই বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই অল্প খরচে রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল, সার, কয়লা, কৃষিজাতপণ্য, রড-সিমেন্ট, পাথরসহ নির্মাণ সামগ্রী ও অন্যান্য মালামাল অতি সহজে আনা-নেওয়া করা যেত এ ঘাট দিয়ে।
শতবর্ষের পুরনো এ ঘাট দিয়ে কত ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, কত ফেরিওয়ালা, হকার, কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, জেলখানার কয়েদি কিংবা নববিবাহিত দম্পতি পার হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে এক বিশাল জনসভায় ছয় দফা দাবির উপর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেছিলেন।
বালিয়াটির জমিদার এবং বিশিষ্ট সমাজসেবী জগন্নাথ বাবুর নামানুসারে ঘাটের নামকরণ করা হয়েছিল; সে নাম নিয়ে 'জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়' এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'জগন্নাথ হল' এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
বাহাদুরাবাদের ন্যায় ২০০৪ সালে যমুনা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হলে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটটিও বন্ধ হয়ে যায়। ঐতিহাসিক ময়মনসিংহ এক্সপ্রেস ট্রেনটি একসময় জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চলাচল করত। বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হলে তারাকান্দি থেকে একটি লাইন জগন্নাথগঞ্জকে বাইপাস করে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে বর্তমানে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে আর কোনো ট্রেন চলাচল করে না।
জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে এখন আর লঞ্চ নেই, ফেরি নেই, ঐতিহাসিক সেই পুরাতন ঘাটটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবে বাংলার রেল ইতিহাস যতদিন বিদ্যমান থাকবে, ততদিন জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের নাম মুছে যাবে না।
গোয়ালন্দ-নারায়ণগঞ্জ
ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ছিল গোয়ালন্দ। পদ্মাপাড়ে এ বন্দরের বিস্তৃতি ছিল কয়েক মাইল জুড়ে। রেলপথে কলকাতার সাথে ঢাকার সর্বপ্রথম যোগাযোগ ব্যবস্থা সাধিত হয় এই গোয়ালন্দ ঘাটের মাধ্যমে। আর ঘটনাটি ঘটে ১৮৭১ সালে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হয় ১৮৬২ সালে। ১৮৭১ সালে এই লাইন বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় গোয়ালন্দ পর্যন্ত।
এদিকে ১৮৮৪ সালে ঢাকা স্টেট রেলওয়ে কোম্পানি নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করে। এতে কলকাতার সাথে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার এক নতুন যুগের সূচনা হয়। রাতের ট্রেনে কলকাতা থেকে যাত্রা করে ভোর নাগাদ এসে পৌঁছানো যেত গোয়ালন্দ ঘাটে। সেখান থেকে স্টিমারে করে পাঁচ/ছয় ঘণ্টায় নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ স্টেশন থেকে ট্রেনে করে ঢাকা পৌঁছান যেত দুপুরের আগেই। তিনদিনের দীর্ঘ যাত্রাপথ নেমে এলো মাত্র ১৭ ঘণ্টায়। শুধু কি ঢাকা? চট্টগ্রাম, সিলেট, গুয়াহাটি, বার্মাসহ পূর্বাঞ্চলের সকল জেলার সাথে কলকাতার যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে গোয়ালন্দ ঘাট।
তখন একটি বড় স্টিমার ও দুটি টাগ স্টিমারের সাহায্যে নারায়ণগঞ্জ ও গোয়ালন্দের মধ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করা হতো। এর মধ্যে প্রিন্সেস এলিস নামক স্টিমারটি সবচেয়ে বিলাসবহুল ছিল।
১৮৭৫ সালের ১০ জানুয়ারি সাধারণীর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল-
পূর্ব্বে গোয়ালন্দ একটি যৎসামান্য গ্রাম ছিল। এখন রেলওয়ে ষ্টেশন হইয়া অতি বিখ্যাত স্থান হইয়াছে। উত্তর, পূর্ব্ব-বাঙ্গালা ও আসাম অঞ্চলের লোকদিগকে কলিকাতা অঞ্চলে যাইতে হইলে এস্থানে আসিয়া রেল গাড়ীতে উঠিতে হয়। বাণিজ্য উপলক্ষে বহুতর বণিক মহাজনের এখানে সমাগম হইয়া থাকে।’ যাত্রীসংখ্যা এতই বৃদ্ধি পায় যে, ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ১৮৭৪ সালে শুধু তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা রুটে রিটার্ন টিকেট প্রবর্তন করে।
গোয়ালন্দ ঘাট থেকে নারায়ণগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের অধীনে স্টিমার চালু ছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কলকাতা থেকে ঢাকা আসতে একটি মাত্র টিকিট ছিল। অর্থাৎ শিয়ালদহ থেকে গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে করে নারায়ণগঞ্জ এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেনে করে ঢাকা এই পুরো যাত্রাপথ একটি টিকিট দিয়ে চলত। তখন ট্রেনে যেমন ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, থার্ড ক্লাস আর ইন্টার ক্লাস ছিল, তেমনি স্টিমারেও ওই চারটি ক্লাস বা যাত্রীশ্রেণী ছিল।
ঢাকায় ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর হিসেবে যোগদানের জন্য এ স্টিমারে যাত্রা করেছিলেন জর্জ গ্রাহাম। তবে তার যাত্রা মোটেও সুখকর ছিল না। যাত্রাপথে প্রমত্তা পদ্মার ঝড়ের কবলে পড়েন তিনি। ১৯১২ সালে ভারতীয় নারী হরিপ্রভা তাকেদা তার স্বামীর ওয়েমন তাকেদার সাথে এই নৌরুটে ভ্রমণ করেন। আর নারায়ণগঞ্জ থেকে তিনি চলে যান জাপান। ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’ শিরোনামে ১৯১৫ সালে এই ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত হয়। ইতিহাস ঘাটলে এরকম অসংখ্যা গুণীব্যক্তির গোয়ালন্দ থেকে স্টিমার ভ্রমণের স্মৃতিচারণ পাওয়া যায়।
পরবর্তী সময়ে বাহাদুরাবাদ, জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের মাধ্যমে ঢাকার সাথে সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ চালু হলে গোয়ালন্দের গুরুত্ব কমতে থাকে। কিন্তু সে স্টিমার ভ্রমণ ছিল যাত্রীদের কাছে অনন্য একটি অভিজ্ঞতা।
সাঁড়াঘাট-দামুকদিয়া ঘাট
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সাঁড়াঘাট ছিল কলকাতার সাথে উত্তরবঙ্গ, শিলিগুড়ি, আসামের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। ১৮৭৮ সালে সাঁড়া থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হলে সাঁড়াঘাট বৃহৎ এবং কর্মচঞ্চল নৌবন্দরে পরিণত হয়। সাঁড়া বন্দরে তখন ১৬টি ঘাট ছিল। সাঁড়ায় রেলস্টেশন নির্মিত হলে এ জনপদ গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে ওঠে।
এপারে দামুকদিয়া ঘাট পর্যন্ত ছিল ব্রডগেজ লাইন। আর সাঁড়াঘাট থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত ছিল মিটারগেজ। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের অধীনে দামুকদিয়া এবং রায়টা ঘাট থেকে সাঁড়াঘাট পর্যন্ত স্টিমার চলাচল করত। জানা যায়, এখানে রেল ফেরিও ছিল। এ রেল ফেরিগুলো শুধুমাত্র মালামাল পরিবাহী ওয়াগন পারাপারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো। সাঁড়াঘাট থেকে দামুকদিয়া ঘাটে ফেরিতে করে মিটারগেজ ওয়াগন নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে ব্রডগেজ থেকে মিটারগেজ ওয়াগনে মালামাল স্থানান্তর করে পুনারায় মিটারগেজ ওয়াগন ফেরিতে করে সাঁড়াঘাটে নিয়ে আসা হতো। অনেকক্ষেত্রে এর উল্টোও করা হতো।
বাংলা সাহিত্যে বারবারই সাঁড়াঘাটের নাম এসেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ছিন্নপত্রসহ একাধিক গ্রন্থে সাঁড়াঘাটে গাড়ি বদলে অপরিসীম হিমশিম খাওয়ার বর্ণনা আনন্দঘন এবং কৌতুকাবহ বলে বর্ণনা করেছেন। সাঁড়াঘাট যে সেসময় কতটা কর্মময় ও ব্যস্ততম বন্দর ছিল, তা সেই বর্ণনা থেকে উপলব্ধি করা যায়। এছাড়া হেমেন্দ্র কুমার রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একাধিক বর্ণনাতেও এ ঘাটের উল্লেখ আছে। তখন ব্রিটিশ সরকার 'দ্য ফেরি অ্যারেঞ্জেমন্টস অ্যাট সাঁড়াঘাট' নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা বাংলায় রেলওয়ের নৌসেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
১৯১৫ সালে পদ্মার নদীর উপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মিত হলে সাঁড়াঘাটের গুরুত্ব কমে যায়। রেলস্টেশন স্থানান্তর করা হয় ঈশ্বরদীতে। সাঁড়াঘাটে আজ আর রেলস্টেশন নেই, ঘাট নেই, বন্দরও নেই। কালের বিবর্তনে সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও সাঁড়াঘাটের সেই পাথুরে বাঁধ দেড়শো বছর ধরে টিকে আছে।
গোয়ালন্দ-চাঁদপুর
চাঁদপুর থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত স্টিমার সার্ভিস চালু করে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে। কিছু কিছু স্টিমার আবার সরাসরি চাঁদপুর থেকে কলকাতা পর্যন্ত চলাচল করত। এছাড়া রেলওয়ের ‘জুট স্পেশাল’ স্টিমার সিরাজগঞ্জ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত চলাচল করত। ফলে স্টিমার কোম্পানিগুলো আগে যেভাবে একচেটিয়াভাবে ব্যবসা করে আসছিল, রেলওয়ে আসার কারণে তা আর সম্ভব হয়নি।
লিখিত অনেক চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ঘাট স্টেশনগুলোর মাধ্যমে চা-পাটসহ বিবিধ পণ্য পরিবহন নিয়ে রেল কোম্পানির সঙ্গে স্টিমার কোম্পানিগুলোর প্রায়ই ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব হতো। যদিও বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স এবং রেলওয়ে বোর্ড উভয়কে সমঝোতার ভিত্তিতে চলার পরামর্শ দিত। ১৮৮৯ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে আইজিএসএন ও আরএসএন জয়েন্ট স্টিমার কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এতে স্টিমার কোম্পানির ক্ষমতা আরো বেড়ে যায়। ১৮৯০–এর দশকে আইজিএসএনের অন্তর্ভুক্ত ছিল ৫৫টি স্টিমার, ৯৬টি ফ্লাট এবং আরএসএসের অধীনে ছিল ৪২টি স্টিমার ও ৮৪টি ফ্লাট।
আইজিএসএন (দ্য ইন্ডিয়ান জেনারেল স্টিম নেভিগেশন) শুরুতে স্টিমার সার্ভিস কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও ১৮৯৯ সালে রেল কোম্পানি হিসেবে রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়ে ইন্ডিয়া জেনারেল স্টিম নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়েজ কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয় এবং রেলওয়ের নৌসেবা দিতে থাকে।
আরো কিছু নৌসেবা
মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা ঘাট থেকে রাজশাহীর গোদাগাড়ি ঘাটে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে পরিচালিত স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল। মালদহ থেকে গোদাগাড়ি ঘাট পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হয়েছিল ১৯০৯ সালে। তখন শিয়ালদহ থেকে যাত্রীরা এসে নামত লালগোলা ঘাটে। লালগোলা ঘাট থেকে স্টিমারে করে পদ্মা পার হয়ে চলে আসত গোদাগাড়ি ঘাটে। গোদাগাড়ি থেকে ট্রেনে করে চলে যেত মালদহ। দেশভাগের পর ঘাটটি বন্ধ হয়ে যায়।
আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের অধীনে নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুরের মধ্যে স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল। নারায়ণগঞ্জ ঘাট রেলস্টেশন থেকে শীতলক্ষ্যার বুক চিরে স্টিমার গিয়ে পড়ত মেঘনায়। সেখান থেকে পদ্মা ও মেঘনার মোহনায় চাঁদপুর ঘাট স্টেশনে চলে আসত। ঢাকার সাথে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এ নৌরুট।
দ্য ইন্ডিয়ান জেনারেল স্টিম নেভিগেশন (আইজিএসএন) এবং রিভার স্টিম নেভিগেশন (আরএসএন) নামে দুটি ব্যক্তি মালিকানাধীন স্টিমার কোম্পানি সর্বপ্রথম বাংলা এবং আসামে স্টিমার সার্ভিস চালু করে। ব্যবসায়িক স্বার্থে স্টিমার কোম্পানির সাথে রেল কোম্পানিগুলোর দ্বন্দ্ব ছিল নিয়মিত ঘটনা। খুলনা-বরিশাল, গোয়ালন্দ-ডিব্রুগড়, আসাম-কলকাতা এবং কলকাতা-চট্টগ্রামের মধ্যে স্টিমার চলাচলের কথা জানা যায়। তবে এগুলো রেলওয়ে পরিচালিত স্টিমার সার্ভিস ছিল না। এগুলো সম্ভবত আইজিএসএন এবং আরএসএন-এর অধীনে পরিচালিত হত।
সেই ঊনিশ শতকে স্টিমার-ভ্রমণকারী কোনো যাত্রীকে আজ আর হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারপরও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে স্টিমার ভ্রমণ করেছিলেন, এমন অনেকেরই স্মৃতিকাতর সাক্ষাৎকার পাওয়া যায়। প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে বয়ে চলা স্টিমারের ছাদে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অনেকটা সাগর ভ্রমণের মতোই ছিল। অথচ পকেটে রাখা টিকেটে স্পষ্ট করে লেখা ছিল, 'ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে'। এভাবেই চলত ব্রিটিশ রেলওয়ের নৌসেবা।
এই সিরিজের পূর্ববর্তী অন্যান্য পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:
১. ভারতবর্ষে রেলওয়ের আগমন-১ম পর্ব
২. প্রথম যেদিন রেল এলো বাংলায়-২য় পর্ব
৩. বিহার দুর্ভিক্ষ ও সাঁড়া-পার্বতীপুর-শিলিগুড়ি রেল সেকশন-৩য় পর্ব
This is a Bengali article. It is the sixth part of the series 'History of Railway in Bangladesh'. It describes the history of the Railway Navy
Necessary references have been hyperlinked inside the article.
Featured Image: railjournal.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন