সম্রাট জাহাঙ্গীর স্বয়ং একদা বলেছিলেন, “আমার রাজ্য আমি এক পেয়ালা মদ আর এক বাটি সুরুয়ার বিনিময়ে আমার প্রিয় রানীর কাছে বেচে দিয়েছি।” এই রানী আর কেউ নন, সম্রাট জাহাঙ্গীরের ৩০ জন মুখ্য পত্নীর মধ্যে তার সবচেয়ে প্রিয় এবং ২৫ তম পত্নী নূরজাহান। এই উক্তি থেকেই বোঝা যায় সম্রাটের উপর তার কতখানি প্রভাব ছিল। সম্ভবত তিনিই একমাত্র নারী যার কোনো মুঘল সম্রাটের উপর এতখানি প্রভাব বিদ্যমান ছিল। নূরজাহান ছিলেন একইসাথে মার্জিত, শিক্ষিত, বুদ্ধিমতি ও কর্তৃত্বপরায়ণ সম্রাজ্ঞী। তার সাথে যোগ হয়েছিল তাঁর নিগুঢ় রাজনৈতিক বিচক্ষণতা। স্বামীর সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল নূরজাহানের। তিনি জানতেন কী করে কাজ আদায় করতে হয়। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের সাথে রুপের উৎকর্ষতা ও তুখোড় কূটনৈতিক বিচক্ষণতা নূরজাহানকে এক স্মরণীয় নামে পরিণত করেছে।

শিল্পীর চোখে নূরজাহান : arabfeed.com

নূরজাহানের জন্ম ১৫৭৫ সালে। তার আসল নাম মেহের-উন-নিসা। পারস্যের অভিজাত বংশীয় মির্জা গিয়াস বেগ ছিলেন তাঁর পিতা। নিজের দুর্দিনে ভাগ্যের অন্বেষণে ভারতবর্ষে পাড়ি জমিয়েছিলেন মির্জা গিয়াস বেগ। কান্দাহারে পৌঁছানোর পরেই তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী কন্যা মেহের-উন-নিসার জন্ম দেন। তখন সম্রাট আকবরের শাসনকাল চলছিল। এক বন্ধুর সহযোগিতায় গিয়াস বেগ সম্রাট আকবরের দরবারে কাজ পান। নিজ মেধার জোরে খুব দ্রুত তিনি দরবারে গুরুত্ব লাভ করেন।

শাহজাদা সেলিম ও নূরজাহানের প্রণয় কথন অতি বিখ্যাত : twitter.com

নূরজাহান ও সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রণয়ঘটিত নানা কাহিনী ছড়িয়ে আছে উপমহাদেশ জুড়ে। জানা যায়, তরুণী নূরজাহান বা মেহের-উন-নিসাকে দেখেই তাঁর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন শাহজাদা সেলিম বা জাহাঙ্গীর। কিন্তু সম্রাট আকবর এ সম্পর্ক মেনে নেননি। তিনি তড়িঘড়ি করে নিজের বাহিনীতে কর্মরত ইরানী সমরনায়ক শের আফগান আলী কুলি খান ইসতাজলুর সাথে ১৭ বছর বয়সে মেহের-উন-নিসার বিয়ে দিয়ে দেন। এরপর তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় সুদূর বর্ধমানে। জাহাঙ্গীর সম্রাট হবার অনতিকাল পরে শের আফগান রাষ্ট্রবিরোধী ও বিদ্রোহমূলক কর্মকান্ডের সাথ জড়িত হয়ে পড়লে সম্রাটের বাহিনীর হাতে নিহত হন তিনি। আবার অনেকে বলে থাকে, এককালের প্রণয়িনীকে পাবার জন্যই শের আফগানকে হত্যা করেন জাহাঙ্গীর। ঐতিহাসিকগণের মতে এর কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই। তবে ঘটনা যা-ই হোক, নূরজাহানের প্রথম স্বামীর বিয়োগ ঘটে। শের আফগানের ঔরসে লাডলী বেগম নামে এক কন্যারও জননী হন তিনি।

১৬০৭ সালে শের আফগানের মৃত্যুর পর নূরজাহান ও তার মেয়ে লাডলী বেগমকে আগ্রায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে মুঘল হেরেমের কর্ত্রী সম্রাট জাহাঙ্গীরের সৎ মা এবং সম্রাট আকবরের প্রধান স্ত্রী রুকাইয়া বেগমের সেবায় তিনি নিয়োজিত হন। মরহুম স্বামীর জীবদ্দশায় তৈরি রাজনৈতিক শত্রুদের থেকে নিরাপত্তার জন্য নূরজাহান নিজেই মুঘল দরবারের আশ্রয় প্রয়োজন মনে করেছিলেন। তার স্বামী রাজদ্রোহী হওয়া সত্ত্বেও তিনি এবং তার কন্যা মুঘল দরবারে যথেষ্ট সম্মানজনক অবস্থান লাভ করেন। রানী রুকাইয়া বেগমের সাথে বিচক্ষণ নূরজাহানের গড়ে তোলা সুসম্পর্ক এর পেছনে বিশাল ভূমিকা রাখে।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের উপর সম্যক প্রভাব ছিল তার : freedamedia.it

নূরজাহানের প্রতি জাহাঙ্গীরের আকর্ষণ যে অনেক আগে থেকেই ছিল, এটা সব সূত্রেই জানা যায়। তখন জাহাঙ্গীরের রাজত্বের ছয় বছর চলছে। ১৬১১ সালের ২১ মে সন্ধ্যায় শাহী মহলের মীনা বাজারে নওরোজের উৎসব দেখতে বের হন সম্রাট। ইরানী সংস্কৃতি অনুযায়ী নওরোজ হলো নববর্ষ বরণ উৎসব। এখানেই এক পোষাকের দোকানে এসে চমকে যান জাহাঙ্গীর। দোকানী রুপসী এক ইরানী কন্যা। এত বছর পরেও মেহের-উন-নিসাকে চিনতে একটুও অসুবিধা হয়নি তার। তৎক্ষনাৎ তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন জাহাঙ্গীর। সেই মাসেরই ২৫ তারিখে, আরবী ১২ রবিউল আউয়াল ১০২০ হিজরী তারিখে মেহের-উন-নিসাকে বিয়ে করে মহলে নিয়ে আসেন জাহাঙ্গীর। নতুন স্ত্রীর রুপে মুগ্ধ হয়েই হয়তো তাঁর নাম দেন ‘নূর মহল’ (মহলের আলো)। বিয়ের পাঁচ বছর পর, ১৬১৬ সালে এই নাম পরিবর্তন করে সম্রাট স্ত্রীর নাম দেন ‘নূর জাহান’ (জগতের আলো)। শুধু একটি মহলই নয়, মেহের-উন-নিসার কীর্তি ও মহিমা মহল ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্যে। তাই ‘নূর মহল’ নামটিতে তাঁকে সীমাবদ্ধ করা যায়নি।

নূরজাহানই একমাত্র মুঘল সম্রাজ্ঞী যিনি নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামের পাশে নূরজাহানের নাম বড়ই সুন্দরভাবে তখনকার মুদ্রায় স্থান পেতো। নূরজাহানের কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা কতো গভীর ছিল এ থেকে সহজেই অনুধাবনযোগ্য। নূরজাহানের পিতা ও তার ভাই যথাক্রমে অর্থ আত্মসাৎ ও বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। নূরজাহান তার প্রভাব খাটিয়ে সম্রাটকে প্ররোচিত করেন তাদের ক্ষমা করে দিতে। শুধু তা-ই নয়, তার পিতাকে দরবারে প্রধান দিউয়ানের পদে উন্নীত করা হয়। নিজের পরিবার পরিজনদের অনেককেই তিনি নিজ প্রভাব বলে প্রশাসন ও বিচার সম্বন্ধীয় উচ্চপদস্থ স্থানসমূহ দান করেন। খান-ই-সামানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয় তার ভাই আসফ খানকে। এই আসফ খানেরই মেয়ে ছিলেন মমতাজ, যার জন্য জাহাঙ্গীরপুত্র শাহজাহান তাজমহল বানিয়েছিলেন। সিংহাসনের সাথে নিজের সংযোগ বজায় রাখার জন্য তিনি ভাইয়ের মেয়ে মমতাজের সাথে সম্রাটের এক পুত্র শাহজাহানের এবং নিজের প্রথম পক্ষের মেয়ে লাডলী বেগমের সাথে সম্রাটের আরেক পুত্র শাহরিয়ারের বিবাহকে প্রভাবিত করেন।

ঘটনাবহুল মুঘল বংশের ইতিহাসে নূরজাহানের কীর্তিও কম নয়। সবাই জানতেন যে নিজ মেয়ের জামাই শাহরিয়ারকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার করতে নূরজাহান সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। ১৬২২ সালে কান্দাহার দুর্গ পারস্যের শাসক অবরোধ করলে খুররমকে (শাহজাহান) দুর্গ পুনর্দখলের জন্য যেতে বলা হয়। কিন্তু তার অনুপস্থিতির সুযোগে নূরজাহান নিজ জামাতা শাহরিয়ারকে সিংহাসনের জন্য পাকাপোক্ত করে ফেলবেন এই ভয়ে খুররম দুর্গ দখলে না গিয়ে উল্টো বিদ্রোহ করে বসেন। জাহাঙ্গীর তার দক্ষ সেনানায়ক মহব্বত খানকে পাঠিয়ে এই বিদ্রোহ দমন করেন। কিন্তু এই বিশৃঙ্খলায় কান্দাহার দুর্গ একেবারেই মুঘলদের হাতছাড়া হয়ে যায়। মুঘল রাজনীতিতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিলেন এই নারী।

সম্রাটের উপর নূরজাহানের অনেক সুপ্রভাবও ছিল। অত্যাধিক মদ্যপানের জন্য সবসময় সমালোচিত সম্রাট জাহাঙ্গীর নূরজাহানের প্রভাবেই মদ খাওয়া কমিয়ে দেন। গরীব-দুখী, এতীম ও বিধবাদের প্রতি নূরজাহান সবসময়ই সংবেদনশীল ছিলেন। নূরজাহান অনেক সমৃদ্ধ সাহিত্যবোধ সম্পন্ন পারসিক পরিবারের মেয়ে ছিলেন বিধায় নিজেও কাব্যচর্চায় অনন্য ছিলেন। একইসাথে তার চর্চা করা ঐতিহ্যবাহী পারসিক আতর তৈরির শিল্প, অতি উন্নত অলঙ্কার ও বুনন শিল্প ভারতবর্ষে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুঘল অবদান।

১৬২৭ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পরে নূরজাহান তড়িঘড়ি করে জামাতা শাহরিয়ারকে সম্রাট ঘোষণা করতে চান। কিন্তু তার ভাই আসফ খান নিজ জামাতা খুররমকে সিংহাসনে বসাতে কৌশলে নূরজাহানকে কারাবন্দী করেন। খুররম পথের কাঁটা, নিজ ভাই শাহরিয়ারকে হত্যা করে ‘শাহজাহান’ নাম নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন। জীবনের শেষ ১৮টি বছর নূরজাহানের বন্দীদশাতেই কাটে। এই পুরো সময় তিনি রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে, তার পিতার সমাধিতে দরগাহ তৈরির তদারকি করে ও কাব্যচর্চা করে দিনাতিপাত করেন। এই সমাধিটি বর্তমানে ইতমাদ-উদ-দৌলার সমাধি নামে পরিচিত। যে পারসিক কাব্যটি এ সময় তিনি লিখেন, তার নাম হলো ‘মাখফি’ (গুপ্ত)।

লাহোরে নূরজাহানের সমাধি : commons.wikipedia.org

১৬৪৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর ৬৮ বছর বয়সে নূরজাহান পরপারে পাড়ি জমান। লাহোরের শাহদারা বাগে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমাধির অদূরেই নূরজাহানের সমাধি। তার কবরের উপরে খচিত আছে, “এই নগন্য আগন্তুকের কবরের উপর না কোনো প্রদীপ থাক, না কোনো গোলাপ। না কোনো প্রজাপতির পাখা পুড়ুক, না কোনো বুলবুলি গান গাক।” কী গভীর দার্শনিক উক্তি! সমাধিক্ষেত্রটি তারই তৈরি করানো ছিল, পঙ্কতিটিও সম্ভবত তারই কাব্য থেকে নেয়া। কাব্য ও দর্শনের কোমলতা ও কাঠিন্যের জটিল সংমিশ্রণ, সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারিনী, সুগভীর কূটনৈতিক জ্ঞানসম্পন্না এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মুঘল ইতিহাসে তো বটেই, সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসেই স্মরণীয়া এক নারী।

ফিচার ইমেজ- ecrater.com