রবিবার, ৪ অক্টোবর, ২০২০

সঠিকভাবে আমরা কি হিন্দু, না হিন্দু নই !

সঠিকভাবে আমরা কি হিন্দু, না হিন্দু নই !


আমাদের জাতিগত বা সমাজগত পরিচয়ে আমরা কোনক্রমেই হিন্দু নই। অতীতকালে এই ভূ-ভাগের নাম ছিল ভারতবর্ষ বা আর্যাবর্ত। এই আর্যাবর্তে যাঁরা বাস করতেন তাঁদের বলা হত আর্য। ‘হিন্দু’ নামটি বিদেশিদের দেওয়া নাম। ফার্সি অভিধান ‘লুগা’তে এই ‘হিন্দু’ নামটি গালি এবং কদর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আরবি ভাষাতেও ‘হিন্দু’ শব্দের অর্থ ‘ঘৃণাযুক্ত’।
ইংরেজ শাসনামলে ভারতবাসীকে তারা ঘৃণাভরে বলত ‘নেটিভ ব্লাক’। আবার কেউ কেউ বলেন ‘সিন্ধু’ নদের নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘হিন্দু’ শব্দ হয়েছে-এটাও ঠিক নয়। ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিকগণ গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন যে, ‘হিন্দু’ নামটি বিদেশি শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া নাম। কালে কালে এই ভূ-ভাগে আর্য জনসাধারণ বিদেশি শাসকদের চাপে ‘হিন্দু’ নামটি স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ১৮৩০ সালে ভারতীয় সংবিধানে ইংরেজ সরকার ‘হিন্দু’ নামটি পাকাপাকিভাবে সংবিধানে জুড়ে দেন। সনাতন ধর্মের প্রামাণ্য ধর্মপুস্তকসমূহ প্রমাণ দেয় যে, আমদের ধর্ম সনাতন ধর্ম বা বৈদিক ধর্ম এবং আমাদের পরিচয় আমরা আর্যজাতি।
যাস্কাচার্যের মতে ‘আর্য’ শব্দের নিরুক্তগত অর্থ ‘ঈশ্বরপুত্র’। অর্থাৎ ঈশ্বরের যথার্থ পুত্রকে ‘আর্য’ নামে সম্বোধন করা হয়। পিতার অনেক পুত্র থাকা সত্ত্বেও পিতার অনুবর্তী, আজ্ঞা পালনকারী, সদাচারী, আদর্শ পুত্রকেই প্রকৃতপক্ষে পুত্র বলা হয়ে থাকে। সেইরূপ, যদ্যপি মানবমাত্রেই ঈশ্বরের পুত্র তথাপি সদাচারপরায়ণ পুরুষকেই ঈশ্বরপুত্র অর্থাৎ ‘আর্য’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
প্রাচীন গ্রন্থসমূহে ‘আর্য’ শব্দের অর্থঃ
বেদঃ
• “আর্যা ব্রতা বিসৃজন্তো অধি ক্ষমি।” (ঋগ্বেদ ১০/৬৫/১১)
• “কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম্।’’ (ঋগ্বেদ ৯/৬৩/৫)
• “বি জানীহ্যার্যান্যে চ দস্যবো বর্হিষ্মতে রন্ধয়া শাসদব্রতান্।” (ঋগ্বেদ ১/৫১/৮)
উক্ত মন্ত্রসমূহে সত্য, অহিংসা, পবিত্রতাদি উত্তম ব্রতধারী ব্যক্তিদের ‘আর্য’ বলা হয়েছে এবং বিশ্বের নর-নারী সকলকে এইরূপ ‘আর্য’ করার উপদেশ দেয়া হয়েছে।
• “আর্যবৃত্ত।’’ (গৌতম ধর্মসূত্র ১৯/৯৬)
এখানে সদাচারপরায়ণ অর্থে ‘আর্য’ শব্দ প্রযুক্ত হয়েছে।
বাল্মীকি রামায়ণঃ
• “সর্বদাভিগতঃ সদ্ভিঃ সমুদ্র ইব সিন্ধুভিঃ। আর্যসর্বসমশ্চৈব সদৈব প্রিয়দর্শন।।” (বাল্মীকি রামায়ণ ১/১/১৬)
অর্থাৎ, রামচন্দ্র সদাসর্বদা সৎপুরুষদের সাহচর্যে থাকতেন যেরূপ সমুদ্র সদা নদীসমূহের সাথে মিলে থাকে তথা তিনি আর্য, সমদর্শী ও সকলের প্রিয় ছিলেন।
বিদুর নীতিঃ
• “আর্য কর্মাণি রজ্যন্ত ভূতি কর্মাণি কুর্বতে হিতং চ নাভ্যসূযন্তি পণ্ডিতা ভরতর্ষভ।
ন স্বে সুখে বৈ কুরুতে প্রহর্ষ। নান্যস্য দুঃখে ভবতি প্রহৃষ্টঃ।।
দত্ত্বা ন পশ্চাৎ কুরুতেহনুতাপং স কথ্যতে সৎপুরুষার্য শীলঃ।।” (বিদুর নীতি ১/৩০/১/১৮)
এই বচনসমূহে অত্যন্ত ধার্মিককে ‘আর্য’ বলা হয়েছে।
চাণক্যনীতিঃ
• “অভ্যাসাদ্ ধার্যতে বিদ্যা কুলং শীলেন ধার্যতে। গুণেন জ্ঞাযতে আর্যঃ কোপো নেত্রেণ গম্যাতে।।” (চাণক্য নীতি ৫/৮)
এখানে গুণীজনকে ‘আর্য’ বলা হয়েছে।
মহাভারতঃ
• “স বাল এবার্যমতির্নৃপোত্তমঃ।” (মহাভারত আদিপর্ব ৪০/৭)
এই বচনে উত্তম রাজকুমারের সাথে ‘আর্যমতি’ বিশেষণ যুক্ত করা হয়েছে যার অর্থ শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমান।
কৌটিল্য-অর্থশাস্ত্রঃ
• “ব্যবস্থিতার্যমর্যাদাঃ কৃতবর্ণাশ্রমস্থিতঃ।”
আর্যগণের মর্যাদাকে যে ব্যবস্থিত করতে সমর্থ সেই রাজ্যাধিকারী, এরূপ বর্ণিত হয়েছে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাঃ
• “কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্। অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরম
র্জুন।।” (ভগবদ্গীতা ২/২)
এখানে যুদ্ধসাজে সজ্জিত ভীরুতাপ্রাপ্ত অর্জুনের বৃত্তিকে ‘অনার্যবৃত্তি’ বলা হয়েছে। এস্থলে আর্যকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে।
ধর্ম্মপদঃ
• “অরিযপ্পবেদিতে ধর্ম্মে সদা রমতি পণ্ডিতো।”
অর্থাৎ, পণ্ডিতগণ আর্যপ্রদর্শিত ধর্মে বিচরণ করেন।
• “ন তেন অরিযো হোতি যেন পাণতি হিংসতি। অহিংসা সব্ব পাণানং অরিযোতি পবচ্চতি।।” (ধর্ম্মপদ ২৭০/১৫)
অর্থাৎ, প্রাণীহিংসা করে কোনও ব্যক্তি আর্য হয় না। যে ব্যক্তি হিংসা করে না সে-ই আর্য।
শব্দকল্পদ্রুমঃ
• “মান্যঃ উদারচরিতঃ শান্তচিত্তঃ ন্যায়পথাবলম্বী প্রকৃতাচারশীলঃ সততকর্তব্যকর্মানুষ্ঠাতা।
যদুক্তং কর্তব্যমাচরন্ কার্যম্ অকর্তব্যমনাচরন্। তিষ্ঠতি প্রকৃতাচারে সতু আর্য ইতি স্মৃতঃ।।” (শব্দকল্পদ্রুম ১০/৫৭)
অর্থাৎ, মান্য(সম্মানযোগ্য), উদারচরিত্র, শান্তচিত্ত, ন্যায়ের পথ অবলম্বনকারী, শাস্ত্রানুকুল আচরণকারী, নিরন্তর কর্তব্যকর্মের অনুষ্ঠানকারী এবং অসৎকর্ম বর্জনকারী পুরুষকেই স্মৃতি অনুসারে ‘আর্য’ বলা হয়।
পাশ্চাত্য বিদ্বানগণ কর্তৃক ‘আর্য’ শব্দের ব্যাখ্যাঃ
• ‘HISTORY OF THE WORLD’ গ্রন্থে ‘আর্য’ শব্দের ব্যাখ্যাঃ
“A tall skinned, long headed race, whose origin is still doubtfull though it was probably in Central Asia and who spread in pre-historic times over the whole of Europe and the parts of Asia and Africa. Almost all modern Europeans are of Aryan descent the family also called Indo-European or Indo-Germanic but these names are open objections from which of the word ‘Aryan’ is free.” (History of the world- Harms worth; Page-328)
• ‘Pear’s Cyclopedia General Mation’ গ্রন্থে ‘আর্য’ শব্দের ব্যাখ্যাঃ
“The word ‘Arya’ is derived from the Sanskrit, means an honourable lord of the soil.”
অর্থাৎ, সংস্কৃতে ‘আর্য’ শব্দের অর্থ মাননীয় ভূস্বামী।
• প্রসিদ্ধ ইংরেজ লেখক Emerson কর্তৃক ‘আর্য’ শব্দের ব্যাখ্যাঃ
“Whenever is open loyal true, of human, and affable demeanour, honourable himself, and in his judgement of other, faithful to his work as to law and faithful alike ton God and man such a man. The flowering of civilization is the finished man the of sense, of grace, of accomplishment of social power-the gentleman” – Emerson
অর্থাৎ, সেই ব্যক্তিই সভ্য ও আর্য যে উদার, নিষ্ঠাবান, সত্যপ্রেমী, দয়ালু এবং সরল। যে স্বীয় দৃষ্টিতে স্বয়ং মহান এবং যে অন্যের সম্মান করে, যে প্রতিজ্ঞা পালনকারী, যে পরমেশ্বর এবং মানবের প্রতি সত্যনিষ্ঠ, যে বুদ্ধিমান, সুন্দর গুণভূষিত, এবং সামাজিক শক্তিসম্পন্ন তথা ভদ্র সেই ব্যক্তিই সংস্কৃত।
• শ্রী অরবিন্দ ঘোষ রচিত ‘What is the significance of the name of Arya’ গ্রন্থে ‘আর্য’ শব্দের ব্যাখ্যাঃ
“The word ‘Arya’ expresses a particular, ethical and social ideal of well governed life, candour, courtesy, nobility, straight dealing, courage, gentleness, purity, humanity, compassion, protection of the weak, liberality, observance of social duty, eagerness for knowledge, social accomplishment; there is no word in human speech that has a nobler history. The Arya is he who strives and overcomes all outside him or within him that stand opposed to the human advance. In every thing he seeks truth, right and freedom.” (Arya Vol 1, p 61)
অর্থাৎ, ‘আর্য’ শব্দ দ্বারা এক সামাজিক তথা নৈতিক আদর্শের, এক মর্যাদাপূর্ণ জীবনের উদারতা, নম্রতা, সজ্জনতা, সরলতা, সাহস, সৌজন্য, পবিত্রতা, মানবতা, বলহীনের সহায়তা, সামাজিক কর্তব্যের অনুষ্ঠান, জ্ঞানপ্রাপ্তির উৎকণ্ঠা ইত্যাদি গুণের বোধ হয়ে থাকে। বাস্তবিকপক্ষে, মানবীয় ভাষায় এরূপ অন্য কোনও শব্দ নেই, যার ইতিহাস এই শব্দ হতে মহান হতে পারে।
অতএব উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে,
• আর্যের সংজ্ঞাঃ
শ্রেষ্ঠ স্বভাবযুক্ত ব্যক্তিই আর্য।
• আর্যের গুণঃ
বিদ্যা, বিনয়, প্রেমপূর্ণ ব্যবহার, চাতুর্য, সময়ানুকুল কর্ম করা, জীবন ও মৃত্যুর ব্যবস্থাকে জেনে অধিক শোক বা হর্ষে জড়িয়ে না পড়া, ঈশ্বরাজ্ঞা ভঙ্গের ভয়।
• আর্যের কর্মঃ
আর্যোচিত গুণের প্রসারার্থে সদা উদ্যমশীলতা, জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য কায়মনোবাক্যের উপযোগ, সজ্জন, গম্ভীর ও উদার পুরুষদের সহযোগ।
• আর্যের স্বভাবঃ
সৌন্দর্য, তেজস্বিতা, পরহিত বিচার, স্বার্থবশীভূত অপরের অপকার করার ভাবনা মনে না আনা।
ইহা যথার্থ যে, যে সমাজে উক্ত আর্যোচিত গুণ, কর্ম ও স্বভাবের যত বিকাশ ঘটবে, সে সমাজ ততই সমৃদ্ধশালী হবে এবং অনবদ্য প্রতিভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
collected
ছবিতে থাকতে পারে: এক বা আরও বেশি ব্যক্তি, যে টেক্সটে 'আমরা হিন্দু না আর্ম?' লেখা আছে
12
6টি কমেন্ট
লাইক করুন
কমেন্ট করুন
শেয়ার করুন
কমেন্ট
  • শেয়ার করেছেন : - প্রণব কুমার কুণ্ডূ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন