·
শতবর্ষে মাহাত্ম্য-মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ একটি বইয়ের প্রতি :
নাম : 'নির্বাসিতের আত্মকথা'
লেখক : উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশ.: 1921
এই বইয়ে যে মানুষদের কথা লেখা, তাঁদের ভূমিকা সরকারীভাবেই disown করা হচ্ছে, এই নতুন গুজরাটি পুঁজি-শাসিত ভারতে l ফলে, খুবই আনন্দদায়ক যে, এ বইয়ের কথা, তার পাতায় পাতায় জীবন্ত বর্ণিত মানুষগুলোর কথা বাঙালিরা খুব কেউ আর জানেন না, জানানোর প্রয়োজনও দেখা যায় না l সৈয়দ মুজতবা আলী এর একটি মুগ্ধ সমালোচনা লিখেছিলেন আজ প্রায় সত্তর বছর বা তার বেশ কিছু আগে l সেটা অনেকে তাঁর 'পঞ্চতন্ত্র' বইয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন l আমি তা পড়লাম ওঁর 'ময়ূরকন্ঠী' সংকলনে , যা 'বেঙ্গল পাবলিশার্স' থেকে 1952 সালের মার্চ-এপ্রিলে প্রকাশিত হয়ে পরবর্তী চার বছরে এগারোটা সংস্করণ হয়েছিল l অর্থাৎ আবির্ভাবেই তা পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিল l কিন্তু কালের গ্রাস কী না গিলে খায় ? সরকারীভাবে যদি আন্দামানের জেলে বন্দীর সংখ্যা অন্য ভারতীয় জাতের থেকে বড্ড বেশী হওয়াটা দৃষ্টিকটু-বোধে নাম কেটে কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে বাঙালি কেন আর 'নির্বাসিতের আত্মকথা' পড়ে না ; এ ভেবে হৃদয় খোঁড়ার নিষ্ফল চেষ্টার কোনো মূল্য থাকার কথা নয় ! সে প্রয়াস আমি করছি না l আমি বইটির শতবর্ষে 'স্মৃতিতর্পন' করছি , এই দেশের অনুতপ্ত নাগরিক হিসেবে l মহাকালের কাছে নিজের কৈফিয়ত এ আমার l কারণ, যে জাতটির অমেয় সম্ভাবনা সত্ত্বেও তার মৃত্যু ঘটছে , সেই জাতটির স্বাতন্ত্র্য এই বইয়ে নিদারুণ ধারণ করা ছিল l মুজতবা সাহেব তার খানিক ব্যাখ্যা করেছেন l এমনকি 'উইকিপিডিয়া' -তে বেশ কয়েকজনের মূল্যবান মতামতও পড়া গেল l
মুজতবা রবীন্দ্রনাথের কপিটি পড়েছিলেন শান্তিনিকেতনে ছাত্র থাকাকালে l রবীন্দ্রনাথ পড়ার পরে গ্রন্থাগারে যাবার আগেই তা তিনি নিয়ে পড়ে ফেলেন ও পরদিন যখন 'কেউ পড়েছে ' কিনা জিজ্ঞাসা করেন রবীন্দ্রনাথ ; তখন, 'পড়েছি' বলে উত্তর দেন বাচ্ছা মুজতবা l এ ঘটনা তো 1921 সালেরই l 'কি রকম লাগল ? ' --- কবির এই জিজ্ঞাসার উত্তরে মুজতবা বলেছিলেন, ' খুব ভালো বই l' সেই উত্তর শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "আশ্চর্য বই হয়েছে l এ রকম বই বাঙলাতে কম. পড়েছি l" সে ঠিক আছে ; রবীন্দ্রনাথের ভালো লেগেছিল বলেই সে বইকে একশো বছর পরেও মাথায় তুলে রাখতে হবে, বাঙালিকে কে এমন দিব্যি দিয়েছে ? সেলুলার জেলে জীবন পচিয়েছিল বলেই কি অতো বাঙালির নাম ( 398 জন ! ) পাথরে খোদাই করে রাখতে হবে ? আর নামকরণ তো জওহরলাল করে রাখতে পারতেন l এমনকি মোরারজীও তো 1978 সালে 'জাতীয় সৌধ' ঘোষণা করার সময়ে কোনো উপযুক্ত বাঙালি বন্দির নামে নামকরণ করতে পারতেন এই বন্দীশালার l করেননি, ইতিহাসকে ফর্দাফাই করে নির্মাণ করার ফাঁক রাখতে হয় বলে ! যা হল, তা তো ঠিকই হ'ল l আমি ওই 'বাঙালি' প্রসঙ্গে বলছিলাম l যে জাতটা ইংরেজকে তাড়ানোর জন্য উন্মাদ হয়ে ভবিষ্যতের কথা না ভেবে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল l ইংরেজ তাকে ঠিক চিনেছিল, এবং অন্য ভারতীয়দের কর্তব্য ঠিকভাবেই নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল l এবং তাদের পরিকল্পনা মসৃণভাবে রূপায়ণও চলছে l বাঙালি নিজের বিনাশ নিজেই ডেকে এনে তা অবশ্যম্ভাবী করায় এখনও লিপ্ত আছে, যতক্ষণ না তার সর্বসম্মান ধুলোয় মিশে যায়, যতক্ষণ না 'বিলুপ্ত জাত' হিসেবে সার্টিফিকেট সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় l কাকে বলা হতো "বাঙালি" ?
---- উপেন্দ্রনাথ এই বইয়ে লিখেছিলেন :
" আমরা হিন্দু মুসলমান সকলকার হাত হইতে নির্বিচারে রুটি খাই দেখিয়া মুসলমানেরা প্রথম প্রথম আমাদের পরকালের সঙ্গতির আশায় উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছিল , হিন্দুরা কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হইয়াছিল ; শেষে বেগতিক দেখিয়া উভয় দলই স্থির করিল যে, আমরা হিন্দুও নই, মুসলমানও নই --- আমরা বাঙালী l " এই 'বাঙালিত্ব' তো ভুসুকুপাদের কাল থেকেই ('চর্যাপদ') আমাদের একান্ত নিজেদের অর্জন ছিল, কিন্তু তার বিসর্জনের বাদ্যি বাজতে শুরু করেছিল অনেকদিন আগেই l এখন তার যে বাজনরব কানে আসছে, সে হ'ল দূর থেকে ঘাটের সন্নিকটের যে ঢাকের বাজন শুনে নিশ্চিত হওয়া যায় যে বিসর্জন সন্নিকট ; এখন সেই বাজনের কালক্ষেপ চলছে আমাদের l আমাদের ভাষাজাতিসত্ত্বা খণ্ডিত হয়েছে, সাহিত্য খণ্ডিত হয়েছে l খসে পড়তে শুরু করেছে জোর করে জোড়াতালি দেওয়া সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ফাঁকির ফাঁক-এর আলাদা মাটি l খসে পড়বে আরও অনেক কিছু , প্রথমেই বুঝি মাথার ওপরে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা হীরে বসানো শৈল-মুকুট দিয়ে তার সূচনা হবে বছরখানেক পরে l আর 'দলিত সাহিত্য' নিয়ে কনৌজি পাঁচ-বামুনের বংশধর আর তাদের পায়ের জুতো বয়ে আনা ওই উত্তরপ্রদেশের 'দলিত' থেকে 'নবশাখ' হওয়া 'জলচল'দের ঝুটো-আভিজাত্য-অস্মিতা-বাহক লেখক, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী, 'কালচার'ওয়ালা বাবুরা গত সেপ্টেম্বর মাসে যা বলল ক'দিন ধরে, তাতে বোঝা গেছে , এ জাত সত্যিই জীবনহারা হয়েই মরণ বরণ করল !
অথচ, অথচ ; জীর্ণ লোকাচারের বাঁধন পায়ে দলার সাধনাতেই এই জাতের স্বাভিজ্ঞান-সাধনা দেখে সকলে আশ্চর্য হয়েছিল ! সে এই পচা উত্তরাধিকারের মধ্যে থেকেও লিখতে শুরু করেছিল নগরের সাহিত্য, যা দূর গ্রামের জনপদবধূও দুপুরের বিশ্রামের আসন বিছিয়ে আস্বাদন করত জাত-ধৰ্ম নির্বিশেষে l মুজতবা আলী একটুও বানোয়াট লেখেননি সেদিন, যখন ওই 'ময়ূরকন্ঠী' বইয়ের 'কোন গুণ নেই তার ---' সন্দর্ভে বলেছিলেন , " এক দিক দিয়ে আমরা যেমন বাইরের জিনিস নিতে শিখলুম অন্য দিক দিয়ে ঠিক তেমনি আপন জিনিসকে অবহেলা না করে আপন সংস্কৃতি-সভ্যতা গড়ে তুললুম l'
সবচেয়ে স্বপ্রকাশ হয়েছে এই তত্ত্বটি আমাদের সাহিত্যে l মাইকেল খৃস্টান, নজরুল মুসলমান এবং প্রমথ চৌধুরীকে ফরাসী বললে কিছুমাত্র ভুল বলা হয় না l অথচ তিনজনই বাঙালী এবং তারা যে সাহিত্য গড়ে তুলেছেন সেটি বাংলা সাহিত্য l "
কিন্তু খেদ করে লাভ নেই l এটা আত্মসমর্পনের কাল, আত্মবিনাশেরও l ইংরেজ কোমর ভেঙেছে প্রথমে 1905-1911, আবার 1947 এ স্থায়ীভাবে l দুদিক থেকেই আমরা ভেবেছি, 'ধর্ম' রক্ষা হচ্ছে ! কিন্তু জাত, ধৰ্ম, ভাষা,চেতনা ---- সবই ক্ষয়ে, ভেঙে, পচে একশা হচ্ছে জেনেও বুঝিনি ! উপেন্দ্রনাথ 1921-এ লিখেছিলেন, " বাঙালীদের আত্মসম্মানবোধ রাজপুরুষদিগের ব্যবহারে প্রতিপদে ক্ষুণ্ণ হইতেছিল বলিয়াই , ইংরেজধিকারে তাঁহাদের মনুষ্যত্ব লাভের সম্ভাবনা ছিল না বলিয়াই , বাঙালীরা তাহাদের ক্ষীণ প্রাণের সমগ্র শক্তি একত্র করিয়া ইংরাজের দুৰ্জ্জয় শক্তি প্রতিরোধ করিবার চেষ্টা করিয়াছিল l " এখন এ বাচন নেহাতই ফেলে আসা অতীত ! সে ছিল এক রোমান্টিক জাত গঠনের স্বপ্নময় আত্মদানের কাল, আমাদের স্বপ্নদর্শী ছেলেরা জেলে গেলে পুলিশ সার্জেন্ট বলে, " এরা এমনি সুবোধ ছেলে যে , বাগানে ( মুরারিপুকুরের ঘোষেদের বাগানে ) ঘুমাইবার সময় রাস্তায় একজন পাহারা পর্যন্ত রাখে নাই "(পঞ্চম পরিচ্ছেদ ) l সুখপাঠ্য ভাষায়, নিজেদের জীবনকে ঠাট্টা করার ঔদার্য নিয়ে উপেন্দ্রনাথ একটি কালজয়ী উপন্যাসের থেকেও অনেক বেশি দ্বন্দ্বময় জীবনের কাহিনীকে পারিপার্শ্বিক-সহ বর্ণনা করেছিলেন এই অধুনা বিস্মৃত গ্রন্থটিতে l মুজতবা আলীর ভাষায় :
" উপেন্দ্রনাথ তাঁর সহকর্মীদের জীবন তথা বাঙলাদেশের পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা নিরীক্ষণ করেছেন অনাত্মীয় বৈরাগ্যে --- তাই তার মূল রাগ সন্ন্যাস --- এবং তার প্রকাশ দিয়েছেন হাস্যরসের মাধ্যমে , দুঃখ-দুৰ্দৈবকে নিদারুণ তাচ্ছিল্ল্যের ব্যঙ্গ দিয়ে l এ বড় কঠিন কর্ম --- কঠোর সাধনা এবং বিধিদত্ত সাহিত্যরস একাধারে না থাকলে এ ভানুমতী অসম্ভব l "
যে আন্দামান থেকে বাঙালি বিপ্লবীদের বৃহদংশের নাম মুছে দেওয়া হ'ল, সেখানে যে নীল্ সমুদ্রে আত্মহারা হওয়ার পরিবেশ ছিল না, তা তো আমরা জানিই l উপেন্দ্রনাথ এর বর্ণনাতেও ( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ) অমরকণ্টকে নদীর ধারে বাঘের ডেরায় পৌঁছানোর বর্ণনায় লিখেছিলেন ,
" ভবিষ্যতে আন্দামানে যাইতে হইবে, সে কথা যদি তখন জানিতাম, তাহা হইলে ছুটিয়া পলাইবার চেষ্টা না করিয়া বাঘের আশায় সেইখানেই বসিয়া থাকিতাম !"
একটি অবিকশিত, মৃত ও বিকাশপর্বেই বিনাশপ্রাপ্ত জাতির আত্মদানের 'জীবন মৃত্যু. পায়ের ভৃত্য' প্রতিপন্ন করা যুবকদের আত্মত্যাগের মুছে যাওয়া আখ্যান-শতবর্ষে তার বর্ণনা ধারণ করা গ্রন্থ এর থেকে বেশী তর্পণ প্রাপ্তির দাবি করতে পারে না l জাতটি থেকেও নাই, আমাদের কারও তাতে খেদও নাই !
শতবর্ষে মাহাত্ম্য-মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ একটি বইয়ের প্রতি :
নাম : 'নির্বাসিতের আত্মকথা'
লেখক : উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশ.: 1921...
আরও দেখুন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন