মলমাস
পুরুষোত্তম ব্রত মহিমা ও নিয়ম ও কিছু কথা
-----------------------------------------------------------
আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ অক্টোবর ২০২০, পর্যন্ত লীলাপুরুষোত্তম ভগবানের প্রিয়তম পুরুষোত্তোম মাস।
শাস্ত্রমতে অধিমাস হলো গুরুত্বপূর্ণ মাসঃ
-----------------------------------------------------
বৈশাখ, মাঘ এবং কার্তিক মাস থেকেও এ মাস সহস্র সহস্র গুণে শ্রেষ্ঠ। এ মাসে সক্ষম ব্যক্তির হবিষ্যগ্রহণ ব্রত এবং সকলেরই শ্রীপুরুষোত্তম কৃষ্ণকে প্রদীপ নিবেদন করা কর্তব্য।
স্ত্রোত্রপাঠঃ
---------------
এ মাসে প্রতিদিন চৌরাগ্রগণ্যং পুরুষাষ্টকম, জগন্নাথাষ্টকম, নন্দনন্দনাষ্টকম, রাধা কৃষ্ণ কৃপা-কটাক্ষস্তোত্রম প্রভৃতি নিজাভীষ্ট স্তোত্রবলী পাঠ ও পূর্বতন আচার্যবৃন্দগন কৃত ভজন কীর্তন করা উচিৎ।
বিশেষ সংখ্যাঃ৩৩
------------------------
এ মাসে তেত্রিশ সংখ্যাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, তাই রাধা-কৃষ্ণের প্রতি ৩৩ বার দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদন করা, ৩৩ সংখ্যক প্রদীপ দান করা, ৩৩ সংখ্যক ফল ও পুষ্প প্রভৃতি যে কোন সেবায় ৩৩ সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। পুরাণে বর্ণিত আছে, এ মাসে কৌশিক মুনি ও তাঁর পুত্র মৈত্রেয় মুনি ব্রাক্ষণগণকে ৩৩ সংখ্যক আপুপ -দান করেছিলেন
। আপুপ মানে আতপচাল, শর্করা ও ঘৃত দিয়ে তৈরি পিষ্টক বিশেষ।
দীপ দানঃ
-------------
এ মাদে দামোদর মাসের মত পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য প্রতি সন্ধ্যায় ঘৃত প্রদীপ নিবেদন করতে হয়। সামর্থ না হলে ঘিয়ের পরিবর্তে তিল তেলের প্রদীপও ব্যবহার করতে পারেন।
''যোগো জ্ঞানং তথা সাংখ্যংতন্ত্রনি সকলানপি
পুরুষোত্তম দীপস্য কলা নার্হন্তি ষোড়শীম।।""
অর্থাৎ ---অষ্টাঙ্গযোগ, ব্রক্ষজ্ঞান, সাংখ্যজ্ঞান এবং সমস্ত ত্রান্তিক কার্য অপেক্ষা পুরুষোত্তম মাসে ভগবানকে দীপ দানের ষোড়শী কলারও তুল্য হয় না।
পুরুষোত্তম মাস কী এবং কেন?
সৌর বছরকে সাধরণত ভাবে গণনা করা হয় ৩৬৫ দিনে, পক্ষান্তরে চন্দ্র বছর গণনা করা হয় ৩৫৫ দিনে।
ফলে ৩৬৫ থেকে ৩৫৫ দশ দিনের পার্থক্য সৃষ্টি হয় সৌরদিবস ও চান্দ্র তিথির মধ্যে। তাহলে তিন বছরে এর পার্থক্য দাঁড়ায় ৩০ দিনে এবং ৩০ দিনে হয় একমাস। এ কারণে ভারতে বৈদিক যুগে প্রতি ৩ বছর অন্তর একটি বাড়তি মাস যুক্ত করে চান্দ্র বছরের সাথে সৌর বছর সমন্বয় করা হয়। এটি ভগবৎপ্রণীত। একে অধিমাস বলে।
এ মাসে কোন কোন সকামকর্মীয় কাজ হয় না। যেমন বিবাহ, পূজা এবং অনন্য অনুষ্ঠানাদি।
চান্দ্রবছর কী?
চন্দ্র বারটি রাশি ও ২৭ টি নক্ষত্রকে অতিক্রম করতে সময় নেয় ২৭ দিন। এই ২৭ দিনে হয় এক চন্দ্র মাস। যদি এই এক চন্দ্র-মাসকে ৩০ ভাগে ভাগ করা যাই এ ৩০ ভাগের প্রত্যেক টিকে বলা হয় এক একটি তিথি। অমাবস্যা পরবর্তী তিথি থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত ১৫টি তিথি ঘটিত ভাগটিকে আমরা বলে থাকি শুক্ল পক্ষ। পক্ষান্তরে পূর্ণিমার পরবর্তী তিথি থেকে আমাবস্যা পর্যন্ত ১৫ টি তিথি নিয়ে সংঘটিত ভাগ কৃষ্ণপক্ষ।
তিথি গুলো সৌর দিনের চেয়ে কিছুটা ছোট তাই চান্দ্রমাস সৌরমাসের চেয়ে ছোট হয়ে থাকে। প্রায় সাড়ে ২৯ দিনে হয় এক চন্দ্রমাস। এরুপ বারটি চন্দ্রমাস নিয়ে তৈরী হয় একটি চান্দ্রবছর। সেই চান্দ্রবছরই হয় ৩৫৫ দিনে ৩৬০টি তিথিতে গণনা। এবং এ ৩৫৫ দিনের গণনা হওয়ার দরুণ যে পার্থক্যের সৃষ্টি হয়, সে পার্থক্য হয় ৩ বছরে ৩০ দিন এবং ৩০ দিনের সেই বাড়তি একমাসকে আমরা অধিমাস বলে অবিহিত করে থাকি।
একবার অসিত, দেবল, অঙ্গিরা বামদেব প্রবৃত্তি ঋষিগণ, নৈমিষ্য অরণ্য ক্ষেত্রে সমবেত হয়েছিলেন ঠিক সেই সময়, সেই পথদিয়ে তীর্থ যাত্রা কালে সে খানে উপস্থিত হন মহর্ষি সুত, তাকে পরম সমাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে ঋষিগণ, তার কাছে মোক্ষ প্রাপ্তি বিষয়ে কথা শুনতে আগ্রহী হন। মহর্ষি সুত বলেন, একবার নারদ মহর্ষি নর-নারায়ণের আশ্রমে উপস্থিত হয়ে ঋষিকে বিনিত ভাবে বলেন। প্রভু পৃথিবীতে ক্রমবর্ধমান ভোগবিলাসী মানুষের অন্ধকার যুগ এই কলিযুগে, মোক্ষ লাভের পথ কি ? উত্তরে মহর্ষি বলেন, এই কলিযুগের মানুষ এ জীবনে পুরুষোত্তম নারায়ণের পবিত্র লীলা কথা শ্রবণ করলে, তার বন্ধনমোচন মোক্ষ প্রাপ্তি ঘটবে।
এ কথা শোনার পর সমবেত ঋষিগণ মহর্ষি সুতের কাছে, এ অধিমাসে ভগবানের লীলাকথা শুনতে লাগলেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অধিমাস প্রসঙ্গে বলেছেন, যারা এমাসে সৎ কর্ম অনুষ্ঠান করবে তারা অচিরে দূঃখ কষ্ট হতে মুক্তি লাভ করবে।
সেই সঙ্গে যারা কৃচ্ছ্রসাধন করবে তারা ইন্দ্রিয়গণকে জয় করতে সক্ষম হবে। অন্য মাস গুলিতে সৎ কর্ম করলে স্বর্গ লাভ হয় কিন্তু ফল ভোগ শেষ হলে আবার পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করতে হয়। এ ভাবে জন্ম মৃত্যুর চক্র হতে মুক্ত হতে পারে না। কিন্তু পক্ষান্তরে এই মলমাসে সৎ কর্ম করলে মোক্ষ লাভ হয়। তথা পূনর্জন্ম হতে মুক্ত হয়।
পুরুষোত্তম মাস সম্পর্কে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর :--
"হে জীব! পুরুষোত্তম মাসে হরিভজনে তুমি এত অলস কেন? এই মাস, যে মাসে, স্বয়ং পরমেশ্বর গোলক সৃষ্টি করেছেন, সেই মাস, সমস্ত মাসের শিরোমণি। এমনকি এটি মহতী পবিত্র কার্তিক, মাঘ ও বৈশাখ মাসের চেয়েও উত্তম। বিশেষ ভজনের মাধ্যমে রাধা-কৃষ্ণের আরাধনা কর। তুমি সবকিছু লাভ করবে ।"
পুরুষোত্তম মাস সম্পর্কে শ্রীল জয়পতাকা স্বামী গুরুমহারাজ --
বৃহন্নারদীয় পুরাণে পুরুষোত্তম মাসের কথা বর্ণিত হয়েছে। সকল মাসের প্রধান, অধিমাস, নিজের স্বভাবজাত বিনম্রতার কারণে, বৈকুন্ঠে নারায়ণের নিকটে এলেন এবং তাঁর অবস্থার বর্ণনা দিলেন। ক্রমান্বয়ে নারায়ণ অধিমাসকে তাঁর সাথে করে গোলকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট নিয়ে গেলেন। কৃষ্ণ, অধিমাসের দুঃখের কথা শুনে, করুণাপূর্ণ হয়ে নিম্নরূপ বললেন। কৃষ্ণ বললেন, "হে রমাদেবীর পতি, জগতে আমি যেভাবে পুরুষোত্তম নামে পরিচিত, এই অধিমাসও তেমনি সারা বিশ্বে পুরুষোত্তম মাস নামে খ্যাত হবে। আমার সকল গুণ এই মাসের মাঝে প্রবেশ করবে। আমারই মত, এই মাস সকল মাসের মাঝে শ্রেষ্ঠ হবে। এই মাস পূজনীয় এবং স্তুতির দ্বারা প্রশংসার যোগ্য। অন্য সকল মাস সকাম, জাগতিক বাসনায় পরিপূর্ণ। এই মাস নিষ্কাম, জাগতিক বাসনাবিহীন। যদি কেউ অকাম বা জাগতিক বাসনা ব্যতীত, অথবা সকাম বা জাগতিক বাসনাযুক্ত হয়ে এই মাসের আরাধনা করে, তাহলে তার সকল কর্মফল নিঃশেষ হয়ে যায় এবং সে আমাকে লাভ করে। আমার ভক্তেরা অনেক সময় অপরাধ করে ফেলে, কিন্তু এই মাসে কোন অপরাধ হয় না। এই মাসে যারা সবচেয়ে নির্বোধ এবং কোন জপ ও দান প্রভৃতি করে না, নিজের পারমার্থিক উন্নতির জন্য যারা কোন কর্ম করে না এবং যারা স্নানাদি করে না, এবং যারা দেবতাগণ, পবিত্র ধাম ও ব্রাহ্মণদের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ, এই সকল দুষ্ট, অসাধু, মন্দভাগ্য লোকেরা, অন্যের সম্পদের উপর জীবন নির্বাহ করে, তারা তাদের স্বপ্নেও সুখ লাভ করে না। এই পুরুষোত্তম মাসে, যিনি প্রেম ও ভক্তিসহকারে আমার আরাধনা করেন, তিনি সম্পদ ও পুত্রাদি লাভ করে, সুখ ভোগ করে, সবশেষে গোলকবাসী হয়।"
আপনি ব্রত ধারনপূর্বত পুরুষোত্তম মাসে লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় হোন এ প্রত্যাশা রাখছি।
জয় পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
শেয়ার করেছেন :- প্রণব কুমার কুণ্ডু
প্রণব কুমার কুণ্ডু
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন