শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৯

জাতিবর্ণ ব্যবস্থা


জাতিবর্ণ ব্যবস্থা
ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন        প্রণব কুমার কুণ্ডু




প্রণব কুমার কুণ্ডু


জাতিবর্ণ ব্যবস্থা (Caste System) বলতে কী বোঝায়? [ PART 2] contd.. from part 1
নিম্নবর্ণের মানুষেরা দুর্বল বলেই কী সংরক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে?
আসলে সংরক্ষণ নিয়ে এরকম একটি ধারণা এমনকি সংরক্ষণের পক্ষে থাকা এবং বিপক্ষে থাকা একটি অংশের মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়। সংরক্ষণ বিরোধীরা কেবল মনে করে যে নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষেরা যেহেতু দুর্বল তাই তাদের অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করা যেতে পারে বা প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু চাকুরী ও উচ্চশিক্ষায় সংরক্ষণ দিলে তা জাতির উন্নতির পক্ষে বিপজ্জনক।
আসলে আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শ এতটাই শক্তিশালী যে এই মতাদর্শের থেকে যথেষ্ট সাবধান না হলে প্রগতিশীল মানুষও এর খপ্পরে পড়তে বাধ্য। বোঝার জন্য একটি পুঁজিবাদী সমাজের কথাই ধরা যাক। সেই অসাম্যভিত্তিক সমাজে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পুঁজিপতিশ্রেণি ও উচ্চমধ্যবিত্তরাই শক্তিশালী এবং শ্রমিকশ্রেণি দুর্বল। কিন্তু তাতে কী এমনটা বোঝায় যে ঐ সমাজে শ্রমিকদের কিছুটা সুযোগ সুবিধা দিলেই একমাত্র শ্রমিকশ্রেণি উন্নতি করতে পারবে। অবশ্য মার্কসের হাতে সমাজ বিকাশের বিজ্ঞান আবিস্কার না হওয়া পর্যন্ত এরকম একটি ধারণা সমাজে জনপ্রিয় ছিল। উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আবিস্কার এইসব ধারণাকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছে। এই আবিস্কারের পর প্রমাণিত হয়ে গেছে যে পুঁজিপতিশ্রেণি কেবল শ্রমিকশ্রেণির তৈরী উদ্বৃত্তমূল্যই আত্মসাৎ করে না, এমনকি সমাজ বিকাশের নিরিখেও তারা হয়ে উঠেছে প্রতিক্রিয়াশীল। একমাত্র শ্রমিকশ্রেণিই সমাজকে নেতৃত্ব দিলে আবার সামাজিক উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটতে পারে। তাই আধুনিক বুর্জোয়া সমাজে শ্রমিকশ্রেণিই সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল ও মতাদর্শের দিক থেকে সবচেয়ে অগ্রণী শ্রেণি।
এই বিষয়টি মাথায় রেখে এবং কোন যান্ত্রিকতার শিকার না হয়ে আমাদের জাতিবর্ণ প্রথার সমস্যাটিকে বুঝতে হবে। জাতিবর্ণ ব্যবস্থা হচ্ছে ভারতীয় অঞ্চলের সামন্ততন্ত্রের একটি বিশেষ রূপ যা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। রূপের দিক থেকে বিভিন্ন হলেও যে কোন সামন্ত ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট হল সমাজের কৃষক সহ অন্যান্য শ্রমজীবি মানুষের তৈরী উদ্বৃত্ত অর্থনীতি বহির্ভূত নিয়মে আত্মসাৎ করা বা অন্য কথায় বলা যায় উদ্বৃত্ত আত্মসাতে মূলগতভাবে বাজারের স্বাধীন প্রতিযোগিতার নিয়ম কার্যকরী না হওয়া। অনেক দেশে যেমন জমির উপর মালিকানাকে কাজে লাগিয়ে এই উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করা হয়েছে তেমনি প্রাক্‌ ব্রিটিশ ভারতে জমির উপর ব্যক্তি মালিকানা ছাড়াই জাতিবর্ণ ব্যবস্থার মাধ্যমে এই উদ্বৃত্তের আত্মসাৎ ঘটেছে। বর্তমানে নানা পরিবর্তনের ফলে এই উদ্বৃত্ত আত্মসাতের যে রূপটি টিকে রয়েছে তাকে বলা যেতে পারে আধা সামন্ততন্ত্র যা আসলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি ও জাতিবর্ণ ভিত্তিক সামন্ততন্ত্রের মিলিত ফল। এখন এই দেশকে যদি একটি গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করতে হয় তাহলে নিশ্চয়ই এই আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকে ভেঙে ফেলতে হবে। আর সেটি করতে হলে জাতিবর্ণের ভিত্তিতে পেশা নির্ধারিত হওয়ার নিয়মটি তথা জাতিবর্ণ ব্যবস্থার কাঠামোটিকেও ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে, না হলে এ দেশে উৎপাদনের বিকাশ ঘটবে না, গণতন্ত্রেরও বিকাশ ঘটবে না। তাই সমস্যাটা নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের দুর্বলতা নয়, সমস্যা এইখানে যে এই সমাজের এমন কোন নিজস্ব গতি নেই যার ভিত্তিতে জাতিবর্ণ ব্যবস্থা ভেঙে গিয়ে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে, সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবে দক্ষতা অর্জন ও সেই দক্ষতার ভিত্তিতে উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে সামাজিক উৎপাদনের বিকাশ ঘটাতে পারে। দেশের একটি বড় অংশের শিশুকে যদি পেটের দায়ে চায়ের দোকান, বাজীর কারখানায় কাজ করতে হয়, লক্ষ লক্ষ পুরুষ ও মহিলাকে কৃষিকাজ সহ অন্যান্য সামাজিক উৎপাদন ছেড়ে মধ্যবিত্ত পরিবারে ঝি, চাকর ও দরোয়ানের কাজ করতে হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষকে যদি ট্রেনে-বাসে-ফুটপাথে সামান্য মূল্যের পণ্য নিয়ে হকারী করতে হয়ত তাতে কী দেশের উন্নয়ন হতে পারে? ইউরোপের কোন উন্নত দেশে কী এমনটা দেখা যায়?
তাই বৈজ্ঞানিক বিচারধারা প্রয়োগ করে বলা যায় যে আসল কাজ হল দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে জাতিবর্ণ প্রথাকে ধ্বংস করা একান্ত জরুরী এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থা হল এই লক্ষ্য অর্জনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলি নিতে হবে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও অন্যতম। শেষ বিচারে নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের মর্যাদা ও অধিকারের জন্য সংরক্ষণের দাবী সহ সমস্ত সংগ্রামই ভারতীয় সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার গণতান্ত্রিক সংগ্রামেরই অংশ।
সংরক্ষণ ব্যবস্থার সুযোগ কী নিম্ন জাতিবর্ণভূক্ত অপেক্ষাকৃত সচ্ছল অংশটিই নিয়ে নিচ্ছে না?
ভারতীয় সমাজে সংরক্ষণের বিষয়টি হটাৎ শাসকদের মাথা থেকে উদয় হয় নি। সমাজে তার বস্তুগত ভিত্তি তৈরী হবার পর থেকেই একমাত্র এই সংক্রান্ত দাবী দাওয়া উঠে এসেছে। আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে ব্রিটিশ ভারতে যে অর্থনীতি গড়ে তোলা হয় তার প্রভাবেই নিম্ন জাতিবর্ণের একটি ক্ষুদ্র অংশ সহরে নানা ধরনের নিম্ন বেতনের পেশার সাথে যুক্ত হয় এবং কালক্রমে শিক্ষার সুযোগ কিছুটা কাজে লাগানোর ফলে তাদের মধ্যেও অপেক্ষাকৃত ছোট একটি মধ্যবিত্তশ্রেণি গড়ে ওঠে। আর স্বাভাবিক নিয়মেই এই মধ্যবিত্তশ্রেণির মানুষের মধ্যেও শিক্ষা ও সরকারী চাকুরীতে অংশ নেবার আকাঙ্খা গড়ে ওঠে। কিন্তু এইসব ক্ষেত্রগুলিতে উচ্চবর্ণের আধিপত্য এতটাই প্রবল ছিল যে তারা কিছুতেই এর ভাগ ছাড়তে প্রস্তুত ছিল না। এইরকম একটি অবস্থায় শিক্ষা ও সরকারী চাকুরীতে সংরক্ষণের দাবী নিম্নবর্ণ থেকে তৈরী হওয়া এই মধ্যবিত্তশ্রেণির আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন।
এই বাস্তবতা চেপে গিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ও তার সহযোগী শাসকেরা বোঝাতে চায় যে সংরক্ষণের উদ্দেশ্য দরিদ্র মানুষদের সাহায্য করা কিন্তু বাস্তবে নিম্নবর্ণের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল অংশের লোকেরাই এই সুযোগ নিয়ে নিচ্ছে। এর মধ্যে দিয়ে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয় যে সরকারী চাকুরী পেতে গেলে বা উচ্চশিক্ষায় যুক্ত হতে গেলে ন্যূনতম কিছু যোগ্যতা অর্জন করতে হয় এবং নিম্ন জাতিবর্ণের ক্ষেতমজুর, ভূমিহীন কৃষকের মত দরিদ্র মানুষেরা সেই যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ পায় না। তাই সংরক্ষণের সুযোগ গ্রহণ করার মত অবস্থায় থাকে নিম্ন জাতিবর্ণভূক্ত মধ্যবিত্ত মানুষ। আর ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি চালাকী করে দরিদ্র মানুষের কথা সামনে রেখে আসলে সংরক্ষণ প্রথাকেই অকার্যকরী করবার অপচেষ্টা চালায়।
মনে রাখা দরকার যে সংরক্ষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষা চাকুরী সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব ঘটানো, এর উদ্দেশ্য দারিদ্র্য মোচন নয় এবং এভাবে দারিদ্র্য মোচনের কথা ভাবাও হাস্যকর। দারিদ্র্য মোচনের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে শ্রমিকশ্রেণির রাজ গড়ে তুলতে হয়, উৎপাদনের উপায়ের উপর ব্যক্তিমালিকানার উচ্ছেদ ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়। খালি তাই নয়, কেবল সংরক্ষণের মধ্যে দিয়ে জাতিবর্ণ প্রথা বিলুপ্তও হয় না, কিন্তু জন্ম দিয়ে পেশা নির্ধারণ হবার প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয় এবং নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা গড়ে ওঠে।
সংরক্ষণের কথা উঠলেই মেধার বিষয়টি সামনে চলে আসে। এটা আমাদের কীভাবে দেখা উচিত?
বর্তমানে ভারতীয় সমাজে নিশ্চয়ই আইন করে নিম্নবর্ণের মানুষদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয় না। নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষ, আদিবাসী, মুসলিম ও খ্রীশ্চান দলিতদের একসাথে ধরলে তারা দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশেরও বেশি। তা সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষা, উচ্চপদের চাকুরী, উচ্চপদস্থ আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার ইত্যাদি পেশাগুলিতে এই অংশের মানুষদের প্রায় খুঁজে পাওয়া যায় না কেন? তাহলে সংরক্ষণ বিরোধী তথাকথিত মেধাবীদের যুক্তিতে বলতে হয় যে এই বিশাল অংশের মানুষের মেধা নেই। কিন্তু কেন এমনটা হল? এই অবস্থা দুটি কারণে হতে পারে;
ক) নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের সাথে উচ্চবর্ণের মানুষের বায়োলজিক্যাল (মস্তিষ্কের গঠনগত বা জিনগত) পার্থক্য আছে যার ফলে নিম্নবর্ণের মানুষের মেধা প্রকৃতিগতভাবেই কম থাকে। হয় নিম্নবর্ণের মানুষের মস্তিষ্ক সেভাবে বিকশিত হয় নি অথবা তাদের জিনগত সমস্যা আছে।
খ) প্রশ্নটি মেধার নয়, আসলে মেধা বলতে যা বলা হয় সেটি অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে নিম্নবর্ণের মানুষকে দীর্ঘকাল বঞ্চিত রাখা হয়েছে। আর এই বঞ্চনাকে যুক্তিসম্মত করতে ধর্ম, কর্মফল সহ আরোও নানা ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করা হয়েছে যাতে নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে জাতিবর্ণভেদের বিষয়টি একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম বলে মনে হয়।
বিজ্ঞানের কোন রকম অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও যারা প্রথমটিকে সত্য বলে মনে করেন তাদের কাছে অবশ্যই সংরক্ষণের কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারে না কারণ যেহেতু জাতিবর্ণগত পার্থক্য প্রকৃতিগত বিষয়, সংরক্ষণ চালু করে এই পার্থক্য দূর করা যাবে না। আর দ্বিতীয়টি যদি সত্য হয় (সেটাই আসলে জাতি-বর্ণ প্রথার ইতিহাস) তাহলে নিশ্চয়ই এই প্রথাকে ঘোচাতে নিম্নবর্ণের মানুষের অধিকার অর্জনের লড়াই জারী থাকবে আর প্রতিটি গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকে এই লড়াইয়ের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাই এটা ঠিক যে সংরক্ষণের পক্ষে লড়াই নিম্নবর্ণভূক্ত অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মধ্যবিত্তশ্রেণির স্বার্থের পক্ষে লড়াই, কিন্তু জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্বের কারণে এই লড়াই নিম্নবর্ণের মানুষের সামগ্রিক গণতান্ত্রিক লড়াইয়েরও অংশ কারণ এই লড়াই নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরী করতে ও সামাজিক মর্যাদার জন্য তাদের সংগ্রামকে বিকশিত করতে সাহায্য করে।
অর্থনৈতিক মানদন্ডের নিরিখে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার দাবী কি সঠিক?
অনেকের মুখেই শোনা যায় যে সংরক্ষণ ব্যবস্থা যদি রাখতেই হয় তবে তা অর্থনৈতিক মানদন্ডের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। এই রাজ্যের শাসকের অংশ হয়ে ওঠা মার্কসবাদীদের মুখেও এরকম কথা শোনা যেত। আমরা যা আগেই বলেছি যে এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে আসলে সংরক্ষণকে কৌশলে দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচী হিসাবে হাজির করা হচ্ছে যা আদৌ ঠিক নয়। যে কোন শ্রেণি সমাজেই দারিদ্র্য থাকে কারণ শ্রেণি সমাজের উৎপাদন সম্পর্ক এমনই যে সমাজে শোষিতশ্রেণি কর্তৃক সৃষ্ট সম্পদ স্থায়ীভাবে শোষকশ্রেণির কুক্ষিগত হয়ে থাকে এবং তার ফলে তা অসাম্যকে ক্রমাগত পুনরুৎপাদিত করে চলে। এই সামাজিক সম্পর্ককে না ভেঙে শোষিত মানুষদের একটি অংশকে কিছু সাহায্য করলে তা কিছুতেই অসাম্যের উৎসকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে না। তাই সমাজে দারিদ্র্যের অবসান ঘটাতে গেলে পুঁজিতন্ত্র সহ সমস্ত শোষণমূলক সম্পর্ক উচ্ছেদ করে তার স্থলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে হয় যা উৎপাদনের উপায়গুলির উপর ব্যক্তিমালিকানার অবসান ঘটিয়ে দারিদ্র্য অবসানের দিকে এগিয়ে যাবার সূচনা ঘটায়।
সংরক্ষণ প্রথা হচ্ছে এমন একটি প্রথা যার লক্ষ্য সীমিত। আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে ভারতীয় অঞ্চলে যে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার উদ্ভব হয় তা শ্রেণি ব্যবস্থার পাশাপাশি অন্য কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট বহন করে এবং সেগুলি তার দীর্ঘ অস্তিত্বের মধ্যে দিয়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানুষের মননক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আর তাই আজও পারিবারিক উপার্জনের ভিত্তিতে অর্থনৈতিকভাবে একই অবস্থানে থাকা একটি উচ্চবর্ণীয় পরিবার ও একটি নিম্নবর্ণীয় পরিবার সামাজিকভাবে আসলে একই রকম সুযোগ সুবিধা ভোগ করে না এবং এই পার্থক্য বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রতি মুহুর্তে প্রতিফলিত হয়। এই কারণেই নিম্ন জাতিবর্ণের এমনকি মধ্যবিত্ত বা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল অংশের মানুষও সমাজের বিভিন্ন সম্মানজনক পেশাগুলিতে সহজে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় না, কারণ এইসব ক্ষেত্রগুলিতে উচ্চবর্ণের প্রবল আধিপত্য বজায় থাকে এবং জাতিবর্ণ প্রথার মতাদর্শের শক্তিশালী অস্তিত্বের কারণে নিম্নজাতির মানুষের সেখানে সুযোগ পাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। তাই অর্থনৈতিক মানদন্ডের কথা বলার অর্থ হল নিম্ন জাতিবর্ণভূক্ত মানুষের যে অংশটি খানিকটা অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কারণে শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করে সংরক্ষণের সুবিধা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়ে উঠেছে তাদেরকে বঞ্চিত করা। এটা কে না জানে যে নিম্নবর্ণের ক্ষেতমজুর বা গরীব কৃষকের ঘরের ছেলেমেয়েরা সাধারণভাবে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ উচ্চ পেশার চাকরীতে আবেদন করবার যোগ্যতাই অর্জন করবার সুযোগ পায় না। এমনিতেই ব্রাহ্মণ্যবাদী কলাকৌশলের ফলে উচ্চ পেশায় সংরক্ষিত পদগুলির একটি বড় অংশ খালি পড়ে থাকে, সেখানে অর্থনৈতিক মানদন্ডের কথা বলার অর্থ হল যেটুকু সংরক্ষিত পদ পূরণ হয় সেটাও বন্ধ করা বা সেগুলিকে উচ্চবর্ণের হাতে তুলে দেওয়া।
জাতিবর্ণ প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই কী উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের মানুষের লড়াই?
প্রথমতঃ জাতিবর্ণ প্রথা যেমন ভারতীয় অঞ্চলের একটি বিশেষ সামাজিক কাঠামো তেমনি তা একটি প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ যা সমাজকে দুর্বল করে, পিছিয়ে রাখে। তাই এখানকার যে কোন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সংগ্রামের লক্ষ্যবস্তু হল জাতিবর্ণ ব্যবস্থা। প্রাচীনকালে যখন জাতিবর্ণ ব্যবস্থা ও শ্রেণি ব্যবস্থা প্রায় সমার্থক ছিল তখন উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের সংগ্রাম শ্রেণিসংগ্রামের রূপ পরিগ্রহণ করতো। কিন্তু জাতিবর্ণ ব্যবস্থা বিভিন্ন সময়ে নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে, কখনো শূদ্রজাতির কোন কোন অংশ কোন কোন অঞ্চলে সামাজিক প্রাধান্যে চলে এসেছে, কোথাও কোথাও তাদের নেতৃত্বে রাজত্ব গড়ে উঠেছে এবং পরবর্তীকালে বিশেষতঃ ব্রিটিশ আমলে অর্থনীতির ক্ষেত্রটি এমন কিছু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে যার ফলে বিশেষতঃ কৃষিক্ষেত্রে কয়েকটি শূদ্রজাতিও বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রাধান্যে চলে আসে। বর্তমানে বেশ কিছু জায়গায় শূদ্রজাতির এই উপরের অংশগুলি অতিশূদ্র তথা দলিত ও আদিবাসী মানুষের উপর নিপীড়ণকারী হয়ে উঠেছে। অপরদিকে এই ব্যবস্থাতে উচ্চবর্ণের একটি অংশ শোষণ ও শাসনে যুক্ত থাকলেও সমস্ত উচ্চবর্ণের মানুষ নিপীড়ক নয়, বরং আজকের অর্থনীতিতে তাদের মধ্যেকার একটি বড় অংশও দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ছাঁটাই ও অর্থনৈতিক মন্দার শিকার। তাই আজকের জাতিবর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম মর্মবস্তুর দিকে থেকে ক্ষমতাসীন শাসক শোষক যারা কিনা জনগণকে বিভক্ত করতে ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শকে কাজে লাগায় তাদের বিরুদ্ধে সমস্ত বর্ণের শ্রমজীবি মানুষের সংগ্রাম এবং তা ভারতে চলমান গণতান্ত্রিক সংগ্রামেরই অংশ।
ভারত যেহেতু একটি পশ্চাদপদ এবং অসম বিকাশের দেশ, অর্থনীতির কোন গতিশীলতা নেই, শিল্প পুঁজি, ব্যাঙ্ক পুঁজি এবং বাজার কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যথা পার্সী, মাড়োয়ারী ইত্যাদিদের হাতে কুক্ষিগত রয়েছে, বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলির উচ্চপদগুলিতে বিনিয়োগ হয় বিভিন্ন আত্মীয়তা ও গোষ্ঠীগত সম্পর্কের ভিত্তিতে তাই এখানে সরকারী চাকুরীই মধ্যবিত্ত মানুষের স্বচ্ছন্দ জীবন যাপনের জন্য কিছুটা সুযোগ করে দেয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই দলিত ও অন্যান্য নিম্নবর্ণের শিক্ষিত মানুষেরা মধ্যবিত্ত জীবন যাপনের লক্ষ্যে সরকারী চাকুরীর প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করে। অপরদিকে বিশেষতঃ নয়া অর্থনীতির জমানায় সরকারী ক্ষেত্রগুলি ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে যার ফলে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণ তথা সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অভূতপূর্বভাবে বেড়ে চলেছে। আর এইরকম একটি অবস্থায় সরকারী চাকুরী ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংরক্ষণ প্রথা বিশেষ দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে। যদিও বিষয়টি জনগণের মধ্যেকার একটি অবৈরীমূলক দ্বন্দ্ব কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা বৈরীমূলক রূপ ধারণ করেছে। সংরক্ষণকে ঘিরে নানা ধরনের জাতিবিদ্বেষ, হানাহানি ও নিম্নবর্ণের মানুষের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকদের একটি অংশ এগুলিকে বরাবরই মদত করে থাকে। অন্যদিকে নিম্নবর্ণের একটি সুবিধাভোগী অংশও নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতার আকাঙ্খা পূরণ করতে উচ্চবর্ণের সমস্ত মানুষকে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করে। এ দুটিই প্রতিক্রিয়াশীল ও তা আসলে জনগণকে বিভক্ত রাখার বর্ণবাদী নীতিকে সেবা করে। এটা ঠিক যে নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষেরা যেহেতু সর্বাধিক শোষিত ও নিপীড়িত তাই তারাই জাতিবর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রধান শক্তি কিন্তু এই ব্যবস্থাকে নিশ্চিহ্ন করতে হলে এই প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের বিরুদ্ধে সমস্ত বর্ণের ও স্তরের শ্রমজীবি মানুষের সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।
ভারতবর্ষে সংরক্ষণ ব্যবস্থা কবে প্রচলিত হয় ও তার সাংবিধানিক রূপ কেমন?
১৮৪৮ সাল থেকে মহারাষ্ট্রে মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে ভাগীদার বা সাম্যবাদী সংরক্ষনের পক্ষে সংগ্রাম চালান আর সেই অর্থে তাকেই সংরক্ষণ প্রথার জনক বলা যায়। আই ধরনের আন্দোলন ক্রমে ক্রমে দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে পড়ে যা পরবর্তীতে অব্রাহ্মণ, অনার্য ও দ্রাবিড়দের ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের রূপ নেয়। দক্ষিণ ভারতে এই আন্দোলন পেরিয়ার আন্দোলন নামে পরিচিত। পরবর্তীতে তামিলনাড়ুতে যে ৬৯ শতাংশ সংরক্ষণ চালু হয় এটা এই আন্দোলনেরই ফসল। এছাড়া বিংশ শতকের গোড়াতেই তথা ১৯০২ সালে কোলাপুর রাজ্যের ছত্রপতি শাহু মহারাজ অনগ্রসর বর্ণের মানুষের জন্য সরকারী চাকুরীতে ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলকভাবে চালু করে।
শিক্ষা, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পেশাগত অবস্থানের ভিত্তিতে যে কয়েকটি জাতিবর্ণের সম্প্রদায়কে সংবিধানের ৩৪১ নং ধারায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তাদের অনুসূচিত বা তপশিলী জাতি (Scheduled Castes) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর যাদের ৩৪২ নং ধারায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তাদের তপশিলী উপজাতি (Scheduled Tribes) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সংবিধানগতভাবে চাকুরী, শিক্ষা ও শাসনবিভাগে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু হয় ১৯৪৭ সাল থেকে যদিও তপশিলী জাতির জন্য সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত সরকারীভাবে গ্রহণ করা হয় ১৯৪৩ সালে। এই কৃতিত্বের দাবীদার ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকর।
ভারতীয় সংবিধানের ১৬(৪) ধারায় সরকারী চাকুরীতে রাজ্যের তপশিলী জাতি ও উপজাতির জনসংখ্যার অনুপাতে সরকারী চাকুরীতে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ১৬(৪ক) ধারায় সরকারী চাকুরীতে পদোন্নতির কথা বলা হয়েছে ও তার সাথে সাথে শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রতি যত্ন নেবার কথা বলা হয়েছে।
সংরক্ষণের বর্তমান রূপঃ
সর্বভারতীয় ক্ষেত্র
তপশিলী জাতি্র জন্য ————১৫%
তপশিলী উপজাতির জন্য ———–৭.৫%
অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতির জন্য——–২৭%
পশ্চিমবঙ্গ
তপশিলী জাতির জন্য ————২২%
তপশিলী উপজাতির জন্য ———-৬%
অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতির জন্য——–৭%
মন্ডল কমিশন কী?
আমরা সংরক্ষণের যে চিত্র আগের প্রশ্নের উত্তরে তুলে ধরেছি তাতে অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতির জন্য যে সংরক্ষণ রয়েছে তা আগে ছিল না। ভারতীয় সংবিধানের ৩৪০ নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনে ভারতের সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে পশ্চাদপদ শ্রেণিগুলির অবস্থা ও সমস্যা নিয়ে অনুসন্ধান করা ও সেগুলি দূর করতে সুপারিশ করার উদ্দেশ্যে যোগ্য লোকেদের নিয়ে কমিশন গঠন করতে পারে। ১৯৫৩ সালে এই লক্ষ্যে প্রথম কমিশন গঠিত হয় যার নেতৃত্বে ছিলেন কাকাসাহেব কালেল্‌কর। ১৯৫৬ সালে এই কমিশনের রিপোর্ট লোকসভায় পেশ হলে সেইসময় কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চাদপদ শ্রেণিগুলির চিহ্নিতকরণ ও তাদের জন্য সংরক্ষণ সম্পর্কিত বিষয়ে এই কমিশন যেসব সুপারিশ করে তা গ্রহণ করে নি। সরকারের বক্তব্য ছিল, “এটা অস্বীকার করা যায় না যে জাতিভেদ ভারতের সমাজ জীবনে সমতা স্থাপনের পথে প্রধান বাঁধা। কাকা কালেল্‌কর কমিশনের রিপোর্টে উল্লিখিত জাতিগুলিকে ‘পশ্চাদপদ’ স্বীকৃতি দিলে তা জাতি-বৈষম্য বজায় রাখবে ও স্থায়ী করবে।” এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার জানায় যে রাজ্য সরকারগুলি তাদের নিজেদের রাজ্যের জন্য তারা ‘অন্যান্য পশ্চাদপদ শ্রেণি’-র তালিকা প্রস্তুত করতে পারে ও সেই অনুযায়ী তাদের রাজ্যে সংরক্ষণ চালু করতে পারে।
এরপর আবার মোরারজী সরকার ১৯৭৮ সালে আর একটি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৯ সালে বি.পি.মন্ডলের নেতৃত্বে এই কমিশন গঠিত হয় এবং এই মন্ডল কমিশন ১৯৮০ সালে তার রিপোর্ট পেশ করে। এই কমিশনের রিপোর্টের মর্মার্থ হচ্ছে তপশিলী জাতি ও উপজাতিদের বাদ দেবার পরেও এ দেশের ৫২% মানুষ অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণিগুলির মধ্যে পড়ে। এই পিছিয়ে পড়া জাতিগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে সামাজিক, শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক মানদন্ডের উপর নির্ভর করে। মন্ডল কমিশনের রিপোর্টেই প্রথম সামাজিক অনগ্রসরতা নির্ণয়ে অর্থনৈতিক বা শ্রেণিগত কারণ অপেক্ষা জাতিবর্ণগত বৈশিষ্টের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়। অনগ্রসরতা নিরুপণের জন্য এই কমিশন ৪টি সামাজিক, ৩টি শিক্ষাগত ও ৪টি অর্থনৈতিক কারণকে পশ্চাদপদতা নির্ণয়ের নির্ধারক হিসাবে গ্রহণ করে। সামাজিক সূচকগুলি এইরকমঃ
যে সমস্ত জাতিগুলি (Castes)
১) অন্যদের দ্বারা সামাজিক অনগ্রসর বলে গণ্য হয়।
২) জীবন ধারণের জন্য মূলতঃ কায়িক শ্রমের উপর নির্ভরশীল।
৩)যাদের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ১৭ বছরের কম বয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েদের সংখ্যা রাজ্যের গড় হারের চেয়ে অন্ততঃ ২৫% বেশি ইত্যাদি।
একইরকমভাবে শিক্ষাগত সূচকের একটি উদাহরণ হল যে সমস্ত জাতির মধ্যে ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে ছেলেমেয়েরা কখনই স্কুলে যায়নি এরকম ছেলে মেয়েদের সংখ্যা রাজ্যগত গড়ের থেকে অন্ততঃ ২৫% বেশি। অর্থনৈতিক সূচকের একটি উদাহরণ হল যে সমস্ত জাতির গড় পারিবারিক সম্পত্তি রাজ্যের গড়ের অন্ততঃ ২৫% নীচে।
সামাজিক প্রতিটি সূচকগুলির জন্য ৩, শিক্ষাগত সূচকের জন্য ২ এবং অর্থনৈতিক সূচকের জন্য ১ পয়েন্ট ধার্য করে সেগুলি সমস্ত জাতিবর্ণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। যে সমস্ত জাতিগুলি ২২ পয়েন্টের মধ্যে ১১ পয়েন্টের বেশি পায় তারাই মন্ডল কমিশন কর্তৃক অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (Other Backward Castes) তালিকাভূক্ত হয়।
জাতিবর্ণ ব্যবস্থার মর্মবস্তু বুঝতে মন্ডল কমিশনের নিম্নোক্ত বক্তব্যটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ; “জাতিবর্ণগত ব্যবস্থার সর্বব্যাপী প্রাধান্যই নিম্নবর্ণের মানুষকে সামাজিকভাবে পশ্চাদপদ ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করেছে। তাদের দারিদ্র্যের কারণ হল সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্যের কারণে তারা পশ্চাদপদ হয়নি। ঐতিহাসিক ও সামাজিক ব্যাখ্যার এই পরিপ্রেক্ষিতে এই মতকে সমর্থন করা যায় না যে দারিদ্র্যের কারণেই মূলতঃ সামাজিক পশ্চাদপদতা এসেছে। বাস্তবত এর উল্টোটাই সত্য।” প্রসঙ্গত গত শতকের ষাটের দশকে মহীশূর রাজ্যে সংরক্ষণের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে যে মামলা (বালাজী মামলা) হয় তার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রীম কোর্টের বক্তব্য ছিল এর ঠিক বিপরীত; “শেষ বিচারে সামাজিক পশ্চাদপদতা অনেকাংশেই দারিদ্র্যের ফল। যে শ্রেণির নাগরিকরা অত্যন্ত গরীব তারা স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ হয়ে পড়ে।”
মন্ডল কমিশনের রিপোর্টে সামাজিক, শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর ভারতীয় জনগণকে তপশিলী জাতি (১৫.%), তপশিলী উপজাতি (৭.৫%) এবং অন্যান্য হিন্দু (৪৩.৭০%) ও অহিন্দু (৮.৪০%) অনগ্রসর শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে যেখানে এই অন্যান্য অনগ্রসর জাতি মোট জনসংখ্যার ৫২%। এই হিসাব অনুযায়ী তপশিলী জাতি, উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতির মানুষেরাই দেশের মোট জনগণের ৭০ শতাংশের চেয়েও বেশি। এরাই প্রাচীন শাস্ত্রে বর্ণিত শূদ্র ও অতিশূদ্র জাতির মানুষ। মন্ডল কমিশন রিপোর্টে আরও দেখা যায় যে সরকারী প্রথম শ্রেণির কর্মচারীর মাত্র ৫.৬৮% তপশিলী জাতি ও উপজাতি এবং ৪.৬৯% অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি। দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীর ক্ষেত্রে এই হিসাবটি যথাক্রমে ১৮.১৮% এবং ১০.৬৩%।
মন্ডল কমিশনের সুপারিশগুলি কী?
১) সমস্ত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারী চাকুরীতে এবং ডাক্তারী, ইঞ্জিনীয়ারিং ইত্যাদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে তপশিলী জাতির জন্য ১৫%, তপশিলী আদিবাসীদের জন্য ৭৫% এবং অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতির জন্য ২৭% আসন সংরক্ষণ করতে হবে। ৫২% মানুষের জন্য কেন ২৭% সংরক্ষণ? এক্ষেত্রে মন্ডল কমিশন সুপ্রীম কোর্টের একটি রায়কে মেনে সংরক্ষণকে সঙ্কুচিত করে। প্রসঙ্গত সংরক্ষণের সর্বোচ্চ সীমা সম্পর্কে সংবিধানে কিছু বলা না থাকলেও সুপ্রীম কোর্টের এই রায়ে বলা হয়েছিল যে মোট সংরক্ষণ ৫০% অতিক্রম করবে না।
২) যেসব এলাকায় অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতির মানুষেরা কেন্দ্রীভূত রয়েছে সেইসব এলাকায় এই অংশের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচী এবং পেশাগত শিক্ষার উপর বিশেষ জোর দিতে হবে।
৩) গ্রামীণ হস্তশিল্পীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং ভর্তুকী সহ ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা করা।
৪) সমস্ত রাজ্যে আমূল ভূমি সংস্কারের উপর জোর দেওয়া।
সংরক্ষণ ভারতে কতটা কার্যকরী হয়েছে?
ভারতবর্ষে গত শতকের ৪০’র দশক থেকে সংরক্ষণ চালু থাকলেও তা সামান্যই কার্যকরী হয়েছে কিন্তু উল্টোদিকে সংরক্ষণের আওতাভূক্ত জাতিবর্ণের মানুষের প্রতি ঘৃণা তৈরী করা হয়েছে ব্যাপকভাবে। ব্রিটিশ আমলের জমিদার, জোতদার, আমলাতন্ত্র, কেরানিকূল ও শিক্ষাব্যবস্থার সাথে যুক্ত মানুষের প্রায় গোটা অংশটাই উচ্চবর্ণের হওয়ার ফলে গোটা শাসন কাঠামো জুড়ে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি চালু রয়েছে যার ফলস্বরূপ সংরক্ষণ প্রথাকে পিছিয়ে পড়া জাতি ও আদিবাসী মানুষের অধিকারের বদলে অনেকটা ভিক্ষার দান হিসাবে দেখানো হয়। সরকার ও প্রশাসনে যুক্ত সংখ্যাগুরু উচ্চবর্ণীয় সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শে আচ্ছন্ন ব্যক্তিবর্গ যেহেতু জাতিবর্ণ ব্যবস্থা বজায় রাখার পক্ষে তাই সংবিধানে স্বীকৃত হলেও তারা নানা উপায়ে সংরক্ষণ প্রথাকে অকার্যকরী করতে চেষ্টা করে এবং কখনই সরকারের পক্ষ থেকে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বৈজ্ঞানিকভাবে তুলে ধরা হয় না। এরকম একটি পরিস্থিতিতে নিম্ন জাতিবর্ণভূক্ত গোষ্ঠীর বেশিরভাগ সদস্যরা নিজেদের পরিচয়পত্র নিতে এবং সংরক্ষণের সুযোগ নিতে সঙ্কুচিত বোধ করে। আবার অনেকে সংরক্ষণের সুযোগ নিলেও সেটিকে প্রকাশ্যে সমর্থন করতে দ্বিধাবোধ করে। আর এইরকম একটি সংরক্ষণ বিরোধী সংস্কৃতি বজায় থাকবার কারণে সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের নিয়োগকারী কর্তাব্যক্তির তপশিলী জাতি ও উপজাতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতার বদলে নিজেদের মনোমত যোগ্যতার মাপকাঠি তৈরী করে আর তার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সংরক্ষিত পদগুলি পূরণ হয় না বা সামান্য কিছু পূরণ করে বাকী পদগুলিকে অসংরক্ষিত করবার চেষ্টা করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে সংরক্ষণ কিছুটা কার্যকরী হয়েছে তার কারণ হল সেইসব ক্ষেত্রে তপশিলী জাতি, উপজাতির মানুষেরা নিজেদের অধিকার আদায়ের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। আজও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি এতটাই শক্তিশালী যে অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজে সংরক্ষণপ্রাপ্ত মানুষদের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঘৃণা প্রদর্শন একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। নানা ধরনের অপকৌশল করে নিম্নবর্ণের মানুষদের সংরক্ষণ থেকে বঞ্চিতই করা হয় না, সরকারী প্রকল্পের রূপায়নের ধরন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌগলিক অবস্থান, ইংরাজী ভাষা নির্ভর সংস্কৃতি ইত্যাদি সবকিছুই থাকে নিম্নবর্ণের মানুষের স্বার্থের প্রতিকূলে।
সংরক্ষণ কতটা কার্যকরী হয়েছে তার নির্দিষ্ট সরকারী হিসাব পাওয়া খুব সহজ নয়। তাই আমরা বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্ন সময়ে পাওয়া তথ্যগুলির ভিত্তিতে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করব। এ ব্যাপারে ১৯৯০ সালে খুশবন্ত সিং ‘ব্রাহ্মণ শক্তি’-র উদাহরণ তুলে ধরতে গিয়ে দেখিয়েছেন;
“আমাদের দেশে ব্রাহ্মণরা জনসংখ্যার ৫.৫ শতাংশের বেশি নয়। অথচ বর্তমানে তারা সরকারী চাকরীর ৭০% দখল করে আছে। সরকারী সহ সচিবের মত ৫০০ উঁচুপদে ব্রাহ্মণবর্ণের মানুষ আছেন ৩১০ জন অর্থাৎ ৬৩%। ২৬ জন প্রধান সচিবের মধ্যে ১৯ জন ব্রাহ্মণ, ১৬ জন সুপ্রীমকোর্টের বিচারকের মধ্যে ৯ জন ব্রাহ্মণ, ৩৩০ জন হাইকোর্টের বিচারকদের মধ্যে ১৬৬ জন ব্রাহ্মণ, ১৪০ জন বৈদেশিক দূতের মধ্যে ৫৮ জন ব্রাহ্মণ, ৩,৩০০ জন আই. এ. এস. অফিসারদের মধ্যে ২,৩৭৬ জন ব্রাহ্মণ। ……… এটা কীভাবে হল আমার জানা নেই। কিন্তু এটা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন যে এটা ব্রাহ্মণদের উচ্চ মেধার জন্য সম্ভব হয়েছে।”
২৫ বছর পরে এই তথ্য আজকের জন্যও সত্যি হয়তো হবে না, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে এটাই হচ্ছে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার কাঠামো। এবার আমরা আরোও সাম্প্রতিককালের তথ্যে চলে আসি। ২০১১ সালে ১৫৪ জন সচিব স্তরের পদে একজনও তপশিলী জাতির লোক নেই, তপশিলী উপজাতির মাত্র চারজন আছে। আই. এ. এস., আই. পি. এস., আই. এফ. এস. পদে ১৩.৯% তপশিলী জাতি, ৭.৩% তপশিলী উপজাতি এবং ১২.৯% অন্যান্য অনগ্রসর জাতির প্রতিনিধিত্ব আছে। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের প্রতিনিধি হিসাবে ভি নারারনস্বামী লোকসভায় এই তথ্য দিয়েছিলেন। এছাড়াও তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় ৭৩টি দপ্তরে তপশিলী জাতির জন্য সংরক্ষিত ২৫০৩৭টি পদ নিয়োগ না হবার ফলে খালি পড়ে আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই শূন্য পদগুলি পূরণ না করে সরকারী খরচ কমানোর নামে বর্তমানে এরকম অনেক পদ বিলুপ্ত করে দেওয়া হচ্ছে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন