রবিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৮

অনির্বাণের ‘পত্রং পুষ্পম্‌’ থেকে


অনির্বাণের ‘পত্রং পুষ্পম্‌’ থেকে


শেয়ার করেছেন         'বর্তমান' থেকে           প্রণব কুমার কুণ্ডু


অমৃতকথা

কুণ্ডলিনী-শক্তি

তুমি অনুভূতির কথা যা লিখেছ, তাতে বুঝতে পারছি, কাজ ঠিক মতই হচ্ছে। ঐ নরম তুলোর মত অনুভবটির কথা খুব ভাল লাগল। ওটি Psychic-এর অনুভূতি, যোগীরা যাকে কুণ্ডলিনী-শক্তি বলেন। ওর নানা রূপ আছে। তোমার বেলায় ওটিকে ‘কিশোরী-চেতনা’ নাম দিতে পারি। এক সময় আমি ওকে বলতাম চম্পাবতী। ওর আত্মোন্মীলনের ছন্দটি বড় সুন্দর। ঠিক ফুল ফোটার মত। ওর মাধুরীতে সমস্ত সত্তাকে ও ঐ আইপোমিয়ার রেশম-চিক্কণ আভায় গলিয়ে দিতে পারে। একটু নীচে নেমে এলে এই চেতনাই আবার অপ্সরা-চেতনায় রূপান্তরিত হয়। নারী তখন মোহিনী হয়। কিন্তু মহাশূন্যের পানে ওকে যদি মেলে রাখা যায়, তাহলে নারী হয় গোপী।
সঙ্গীতের বৈদিক আর লৌকিক ভেদ নিয়ে পণ্ডিতদের আলোচনা বহিরঙ্গ আলোচনা মাত্র। বৈদিক সঙ্গীতের অর্থাৎ সাম-সঙ্গীতের মূলভাবটা হচ্ছে পৌরুষের বা রাগের। মহাব্রত-যাগে মেয়েদের গাইবার বিধান ছিল, তা সামগান নয়। আমার বিশ্বাস, তাতে রাগিণীর বিকাশ হতো। ঐ ধারাই দেশী সঙ্গীতের ধারা। সঙ্গীতেও পুরুষ-প্রকৃতির সংমিশ্রণ হয়েছে। সঙ্গীতের মূল কথাটা হল স্বরের বিন্যাসে ভাবের জাগরণ। আমাদের সাধারণ কথা ও সুর আছে, তাই দিয়ে বাচ্যার্থকে ছাপিয়ে সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাকে প্রকাশ করি। যে সুরে দৃঢ় সঙ্কল্প প্রকাশ পায়, সে সুরে তো আদর-সোহাগ প্রকাশ পায় না। ভাব অনুভাবে (expression) অভিব্যক্ত হয়, অর্থাৎ সুর রূপ নেয়। যে গায় বা বাজায় প্রথম রূপ নেয় তার মাঝে। তারপর তা শ্রোতাতে সংক্রামিত হয়। দুয়ের যোগাযোগে সুর ভাবলোকে মূর্তিমান হয়। তখন তাকে প্রত্যক্ষ হতে দেখা যায়। আধুনিক ওস্তাদী গানে আমি দেখি শুধু নানা কসরত; অনুভাবের পরিচয় হতাশাজনক রূপে কম। সুর যদি আসরের আবহে মূর্তি না নিতে পারল, তাহলে সবই বৃথা। কীর্তনে তবুও অনুভাব কতকটা ফোটে, কিন্তু অন্যত্র বলতে গেলে কিছুই না। artist এবং শ্রোতা দুই-ই সেসব জায়গায় বর্বর। রবীন্দ্রনাথের ‘গাহিছে কাশীনাথ’ কবিতাটি মনে করো। সেখানে আবহ-সৃষ্টির ইঙ্গিত আছে। এই আবহ-সৃষ্টি না করতে পারলে স্বর হতে রূপের সৃষ্টি হয় না।
পতঞ্জলি চিত্তকে পঞ্চভূমিকে বলেছেন— তিনটা ভূমি প্রাকৃত গুণময়, দুটা ভূমি অপ্রাকৃত। পাঁচ ভূমিতে পাঁচরকম ভালবাসা ফোটে। মূঢ়ভূমির ভালবাসা অন্ধ জৈব আকর্ষণ— যা সর্বজীবসাধারণ। ক্ষিপ্তভূমির প্রেম রজোগুণময়, তাতে চাঞ্চল্য আছে লালসা আছে, যার ছবি চারিদিকে ছড়ানো। বিক্ষিপ্তভূমির প্রেম সাত্ত্বিক। সেখানে প্রেম idealised— রবীন্দ্রনাথের মহুয়াতে তার অনেক নিদর্শন ছড়ানো। এই প্রেমই সুস্থ সমাজ গড়তে পারে। তার পরের ভূমি হল একাগ্র এবং নিরুদ্ধ। এই একাগ্রভূমির প্রেমই গোপীর প্রেম। এটা মনের ওপারে বিজ্ঞানভূমির কথা। কিশোরীচেতনায় এটি খুব সহজেই আসে। তারও উজানে আকাশের শূন্য নিস্পন্দ চেতনায় জাগে আত্মারামের ভালবাসা— চিত্তের নিরুদ্ধভূমিতে। এই হলো পুরুষোত্তমের প্রেম। সে প্রেম প্রসন্ন উদার স্নিগ্ধতায় জগতের পানে চেয়ে আছে, আর মহাপ্রকৃতি বিবশ হয়ে তার বুকে ঢলে পড়ছে। বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রকৃতির প্রেমকে সুন্দর করে আঁকা হয়েছে; কিন্তু ঐ পুরুষের প্রেমের ছবি কোথাও ফুটতে দেখিনি। আমার কতকগুলি কবিতায় তাকে রূপ দিতে চেষ্টা করেছিলাম।
কিশোরীর ভালবাসা জৈব আকর্ষণে জড়ের দিকে নেমে যাবার সময় ঐ অপ্সরা-চেতনার সৃষ্টি হয়। এইখানকার ছবিটাই বৈষ্ণব কবি একটু বেশী ফলাও করে বর্ণনা করেছেন, যেটা আমি বৈষ্ণব কবিতার ত্রুটি বলে মনে করি। জৈব আকর্ষণটা হ’ল প্রকৃতির একটা কৌশল। বহু জীব সৃষ্টি করে তার থেকে বাছাই করে-করে একদিন হয়তো সে চিরকিশোর আর চিরকিশোরীকে পেয়ে যাবে ঐ Natural Selection-এর তাগিদে, তাই কিশোরীকে নামিয়ে আনে নীচে। এটা তার সকরুণ sacrifice বলতে পার। কি করা? Matter থেকে spirit কে evolved হতে হলে এই ভুলের মাশুলটুকু দিতে হবে যে!

অনির্বাণের ‘পত্রং পুষ্পম্‌’ থেকে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন