প্রাক্-স্বাধীনতা আন্দোলন
ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন প্রণব কুমার কুণ্ডু
Somen Sharma Ek Mushfir
: সভাপতি নির্বাচিত হলেন রাসবিহারী বসু :
.
তখনও সিঙ্গাপুরের পতন হয়নি।খবর এল,ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ(Indian Indipendence League)এক নতুন পরিকল্পনা নিয়ে গঠিত হয়েছে। যুদ্ধের আগে ১৯৩৬ সালে পন্ডিত জহরলাল নেহরু মালয় ভ্রমণে এসেছিলেন।মালয়ে তখন আমাদের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (Indian Association) নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। পন্ডিত নেহরুর উৎসাহ ও উদ্দীপনায় সারা মালয়ে এটি একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল।
.
বিপ্লবী নেতা শ্রদ্ধেয় রাসবিহারী বসু ১৯১৬ সাল থেকে জাপানে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। জাপানিরা যখন প্রথম মালয় আক্রমণ করল ভারতহিতৈষী রাসবিহারী সেদিন টোকিও শহরে স্থির থাকতে পারেননি। এখানে তিনি স্বামী সত্যানন্দপুরী,প্রিতম সিং,ক্যা: আক্রম খান, দেবনাথ দাস প্রমুখ প্রবাসী ভারতীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে ভারতকে কিভাবে স্বাধীন করা যায় তার পরিকল্পনা স্থির করতে লাগলেন।এ সময় রাসবিহারী বসু এদের একান্ত ও একনিষ্ঠ সাহায্য না পেলে আজাদ হিন্দ সংঘ, আজাদ হিন্দ ফৌজ বা আজাদ হিন্দ সরকার গঠিত হতে সম্ভবত আরও প্রচুর সময় লাগত ও সেই সঙ্গে নানারকম বাধারও সৃষ্টি হত।
.
স্বামী সত্যানন্দপুরী বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার অধিবাসী।বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলার বুকে ১৯০৫ সালে যে বিপ্লবী শক্তি আত্মপ্রকাশ করেছিল স্বামী সত্যানন্দপুরী তারই একজন বিশিষ্ট সদস্য।রাসবিহারী বসুর মতো তিনিও দেশকে স্বাধীন করার আকাঙ্ক্ষায় বাইরের শক্তির সাহায্যলাভের জন্য বিদেশে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন।শ্যামরাজ্যের রাজদরবারে ও উচ্চপদস্থ কর্মচারিদের মধ্যে তার বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল।তারই প্রভাবে ও চেষ্টায় শ্যামদেশে ভারতীয়রা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন।
.
রাসবিহারী বসু ব্যাঙ্ককে বসে Indian Independence League গঠন করলেন এবং সারা মালয়ে শাখা-প্রশাখা গঠনেরও ব্যবস্থা পাকা করে ফেললেন।মালয়ের Indian Association-এর কর্মীরা অনেকেই এই নবগঠিত লীগে যোগ দিয়ে বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার নিলেন। নবগঠিত সংগঠনের কাজ দেখতে দেখতে বেশ জোরদার হয়ে উঠল।
.
এই সময় Indian Independence League-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বৃটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ক্যাপ্টেন মোহন সিং-এর নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর পতনের পরের দিনই আজাদ হিন্দ ফৌজ(Indian National Army) গঠিত হল। রাসবিহারী বসু ও আরও অনেকের চেষ্টায় এই ফৌজ Indian Indipendence League-এর সঙ্গে একত্রে কাজকর্ম শুরু করল।লীগ(সংক্ষেপে I.I.L) এবং ফৌজ (I.N.A) বৃটিশ শক্তিকে ভারতের মাটি থেকে উৎখাত করার জন্য স্বাধীনতার প্রস্তুতি চালাতে লাগল। নিপীড়িত,লাঞ্ছিত ভারতবাসী অনেকেই জন্ম থেকে বৃটিশ শক্তির প্রবল প্রতাপ দেখে বিষ্ময়ে অভিভূত হয়েছে। তাদের কাছে ইংরেজরা ছিল অসীম শক্তি ও সাহসের প্রতীক। কিন্তু এখানে সেই প্রবল পরাক্রান্ত প্রভূ ও মহাবীরদের উল্কাবেগে পলায়ন ও ক্ষুদ্রাকৃতি জাপানিদের হাতে তাদের করুণ অবস্থা দেখে আমাদের মতো গৃহসুখি আপাত-শঙ্কিত মানুষেরাও স্বাধীনতার বাস্তব কল্পনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠল। আমাদের মনে হল, ভারতের স্বাধীনতা আর অবাস্তব আকাশ-কুসুম কল্পনা নয়। বরং একতা, বিশ্বাস ও আত্মোৎসর্গের নীতি নিয়ে এগিয়ে চললে বিজয়লক্ষ্মী নিশ্চয় আমাদের জয়মাল্য দেবেন।
.
১৯৪২ এর এপ্রিল মাস। আমাদের রবার বাগানের কাজকর্ম কিছু কিছু শুরু হয়েছে। এমন সময় সিঙ্গাপুর থেকে আমার বোন আমাকে সেখানে যাবার জন্য খবর পাঠাল।একই সঙ্গে উত্তর মালয় থেকে আমার বন্ধু ডঃ সুধীরানন্দ রায়ের (রাজশাহী) চিঠি পেলাম। তিনি আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে লিখলেন।এর কিছুদিন পরেই মোটামুটি নিয়মিত ট্রেন চলাচল শুরু হল এবং ডাকও নিয়মিত বিলি হতে থাকল।ফলে আমরা প্রবাসী বাঙালী বন্ধুরা একত্রে মিলেমিশে নিজেদের সমস্যাবলী সম্পর্কে আলোচনা ও পরামর্শ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। Indian Indipendence League কতটা কাজ চালাতে পারবে এবং আমাদেরই বা কি কর্তব্য তাও স্থির করার প্রয়োজন হল।
.
ব্যাঙ্ককে তখন লীগের উদ্যোগে সমগ্র পূর্ব এশিয়ার প্রবাসী ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সম্মেলনের ব্যবস্থা হয়েছিল। ডঃ রায়ের অনুরোধে ওই সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে আমি সিঙ্গাপুর গেলাম। পথে যেতে যেতে অসংখ্য ভাঙ্গা,পোড়া, আধপোড়া নানা আকারের মিলিটারি ট্রাক ও দামী দামী সব মোটরগাড়ি চোখে পড়লো। আশেপাশে লোকেরা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো কেউ চাকা,কেউ মেশিনের অংশ,ব্যাটারি ইত্যাদি খুলে নিয়ে যাচ্ছিল। সিঙ্গাপুরে ঢোকার সময় দেখলাম অগ্নিদগ্ধ বড় বড় বহু পেট্রোল ডিপোর ধ্বংসাবশেষ।
.
সিঙ্গাপুর যুদ্ধে জাপানি গোলাবর্ষণে মাত্র একজন বাঙালি মারা গিয়েছেন। তিনি আমার ভগ্নিপতির ছোট ভাই, ডঃ অনিল সিংহ।তার বাবা বৃদ্ধ ডাক্তার কিরণ চন্দ্র সিংহ শেলের আঘাতে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ইংরেজ সমরনায়করা সিঙ্গাপুরের সরকারি হাসপাতালকে অন্যায়ভাবে সৈন্যাবাস করার ফলেই এইসব শোচনীয় দূর্ঘটনা ঘটে।আহতরা চিকিৎসার সুযোগ পাননি।
.
সিঙ্গাপুরে কাংডান কারবাউ হাসপাতালের পিছনেই পরাজিত অস্ট্রেলিয় ও ইংরেজ সৈন্যদের বন্দী শিবির খোলা হয়েছিল।দেখলাম বিশাল মাঠে বন্দীদের বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। চারপাশে পাহারা দিচ্ছে জাপানি সৈনিকরা। জীবনে এরকম দৃশ্য এর আগে কখনও দেখিনি। স্বীকার করতে কুন্ঠা নেই এই দৃশ্য দেখে বেশ আনন্দই পেয়েছিলাম। একটা দৃশ্য এখনও ভুলিনি।বন্দীশিবিরের একদিকে বড় রাস্তার পাশে আমাদের মতো অনেক কৌতুহলী পথচারী দাঁড়িয়ে আছে।অন্যদিকে নগ্নপদ,নগ্নগাত্র বন্দী ইংরেজ সৈন্যরা করুণ চোখে তাদের দিকে তাকাচ্ছে। কোথায় গেল তাদের ঔদ্ধত্য আর অহংকার ! মাঝে মধ্যে দুএকজন চীনা জাপানি মিলিটারি পুলিশের চোখ এড়িয়ে অতি সন্তর্পনে নিজেদের কাপড়ে লুকনো পাউরুটির টুকরো কিংবা বিস্কুটের দলা পথের এপাশ থেকে শিবিরের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। রুটি বা বিস্কুটের টুকরো মাটিতে পড়তে না পড়তেই পাঁচ সাত জন সাহেব উন্মাদের মতো তা হস্তগত করার জন্য সে কি ভীষণ মারামারিই না করছে!অথচ এরাই এই যুদ্ধ শুরুর আগে নোংরা এশিয়াটিকদের সঙ্গে এক ট্রামে বাসে ট্রেনে চলা খুবই আপত্তিজনক - তাদের ইংরেজি দৈনিক মারফত এ কথা প্রচার করতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হয়নি।
.
সিঙ্গাপুরে তখন Indian Independence League ও আজাদ হিন্দ ফৌজের কাজ পুরোমাত্রায় চলছে। আমরা আজাদ হিন্দ ফৌজের বহু সৈনিককে কাফে,হোটেল,রেস্তোরাঁয় এবং রাজপথে প্রকাশ্যে সগর্বে চলাফেরা করতে দেখেছি। সিঙ্গাপুরের কয়েকজন ভারতীয়র বাড়িতেই আজাদ হিন্দ ফৌজের বহু বাঙালি সেনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। এদের সকলের নাম আজ মনে পড়ে না। তবে এদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আমার গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। তার নাম সঞ্জীব ব্যানার্জী। তার বাড়ি ছিল কলকাতা। তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে মিলিটারি ট্রেনিং শেষ করে বৃটিশ ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে সিঙ্গাপুরে আসেন।জাহাজে আসার সময় জাপানি বিমানের অভ্রান্ত বোমাবর্ষণে সিঙ্গাপুর থেকে প্রায় সত্তর আশি মাইল দূরে গভীর সমুদ্রে তাদের জাহাজডুবি হয়। সমুদ্রে তারা প্রায় দশ ঘণ্টা লাইফবেল্টের সাহায্যে ভেসে থাকেন।পরে ইংরেজদের আরেকটি জাহাজ এসে তাদের সকলকেই উদ্ধার করে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যায়।
.
সঞ্জীবের সঙ্গে পরে আর আমার দেখা হয়নি। কিন্তু আমি গুপ্ত বিভাগে যোগ দেওয়ার পর শুনেছিলাম যে, তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের গুপ্ত বাহিনী " বাহাদূর গ্রুপে "কর্ণেল বুরহানুদ্দিনের অধীনে স্থলপথে ভারত অভিমুখে রওনা হয়েছেন।পরে বুথিডং-এ ইংরেজদের হাতে ধরা পড়েন। তার প্রাণদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ফাঁসির আদেশ মুকুব করে তাকে দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়েছিল।১৯৪৬-এর সেপ্টেম্বর মাসে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
.
সিঙ্গাপুরে অস্ট্রেলীয় সেনাদের একটি ক্লাব ছিল-এনজাগ ক্লাব।ওই পরিত্যক্ত ক্লাব বাড়িটিকেই আমাদের আজাদ হিন্দ সংঘের(Indian Independence League) অফিস করা হল।ব্যাঙ্কক সম্মেলনে যাব বলে এখানে এসেছি। সেজন্য লীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করলাম।সঙ্ঘের সম্পাদক সভাপতিরা তখন সিঙ্গাপুরেই । কিন্তু লীগের অফিসে সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ সুবিধা না হওয়াই তাদের সদর দফতর Mount Pleasant অফিসেই রওনা হলাম। এসব অঞ্চল তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের অধীনে। পথে যেতে যেতে দেখলাম বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় সেনারা পাহারা দিচ্ছেন। অদূরে জেনারেল মোহন সিং-এর অট্টালিকায় আমার পক্ষে ব্যাঙ্কক সম্মেলনে যোগদানের নানাবিধ অসুবিধার কথা আলোচনা হল।তারা আমাকে নিজের এলাকায় আজাদ হিন্দ সংঘকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দিলেন। আমি সিঙ্গাপুর থেকে স্ত্রী-পুত্র কে নিয়ে আবার আমাদের পুরনো রবার বাগানে ফিরে এলাম।
.
১৯৪২ সালের ১৫ই জুন ব্যাঙ্কক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনে রাসবিহারী বসুকে সভাপতি করে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হল ।
.
ক্রমশ............
তথ্যসূত্র - নেতাজির সিক্রেট সার্ভিস ।
লেখক - ডঃ পবিত্রমোহন রায় ।
Pranab Kumar Kundu
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন