রবিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্


ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্
ফেসবুক থেকে          শেয়ার করেছেন            প্রণব কুমার কুণ্ডু

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্- ৪৯তম প্রয়াণ দিনে ক্ষণজন্মা মানুষটির জন্য রইলো হৃদয় মন্দিরের নৈবেদ্য।
****
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর কতোগুলো পরিচয় দেবো? তাঁর মতো বহু ভাষাবিদ সুপন্ডিত ব্যক্তি পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর কেউ আছেন কিনা সন্দেহ। তাঁকে বোঝার কতোটুকু ক্ষমতাই বা আছে আমাদের? তিনি ছিলেন এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাতত্ত্ববিদ, জ্ঞানতাপস, ভাষাবিদ, গবেষক, লোকবিজ্ঞানী, অনুবাদক, পাঠ-সমালোচক, সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যিক, কবি, ভাষা-সৈনিক। জ্ঞানপ্রদীপ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন বাঙলা ভাষার গবেষণায় অদ্বিতীয়। তিনি ছিলেন একটি কাল, একটি শতাব্দী, একটি জাতি, একটি সংস্কৃতি; অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, ধর্মবেত্তা ও সূফীসাধক। আর সবকিছুর উর্ধ্বে তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক বাঙালি, তাঁর হৃদয়ের আরশিতে বাঙালির, আর একটু ছোটো করে বললে (কিন্তু সুনির্দিষ্ট করে নয়) বাঙালি মুসলমানের যে অবয়বটি ধরা পড়ে- তা তুলনারহিত।
(২)
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বহু ভাষাবিদ পন্ডিত ব্যক্তি হিসাবে সকলের নিকট সমাদৃত ছিলেন। তিনি যেসব ভাষা লিখতে, পড়তে ও বলতে পারতেন তার সংখ্যা হলো ২০টি। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরাজি, সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, হিব্রু, আরবি, প্রাচীন ফারসি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, ওড়িয়া, মৈথিলি, অহমিয়া, নেপালি, তিব্বতি, প্রাচীন সিংহলি, পোশতু, ফরাসি, জার্মান প্রভৃতি। এছাড়া, তামিল, তেলেগু, মালায়ালম, সিন্ধি, মহারাষ্ট্রি, বেলুচি, ল্যাটিন, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ড্যানিশ, ইতালীয়, মালদ্বীপি, তুর্কি প্রভৃতি আরো প্রায় দু'ডজন ভাষায় তাঁর যৎসামান্য দখল ছিল।
(৩)
তাঁর মতো বহু ভাষাবিদ সুপন্ডিত ব্যক্তি পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর কেউ আছেন কিনা সন্দেহ। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার উদ্ভব, বিকাশ ও তাঁর তুলনামূলক বিচারে তিনি অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। তুলনামূলক ভাষাতত্তেব তাঁর মতো অভিজ্ঞ ও পারদর্শী ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। বাংলা ভাষার উৎপত্তি, বিকাশ ও কাল-নিরূপণে তাঁর সমকালীন পন্ডিত-গবেষকদের মতামত খন্ডন করে তিনি নিজের মতকে অকাট্য যুক্তিসহ উপস্থাপন করেছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রণয়নেও তিনি অনেক অজানা তথ্যের উপস্থাপন করে আমাদের ভাষা-সাহিত্যের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর অবদান কেবল তুলনাহীনই নয়, অনন্য বলা চলে।
(৪)
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা তাঁর জ্ঞানের তুলনায় হয়ত পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু তিনি যা লিখেছেন তার অধিকাংশই আকর গ্রন্থ হিসাবে সর্বমহলে সমাদৃত হয়েছে। বিশেষভাবে তাঁর সাহিত্যের ইতিহাস-বিষয়ক গ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যের কথা' এবং ভাষাতত্ত্বের উপর গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত', ‘ভাষা ও সাহিত্য' এবং ‘বাংলা ব্যাকরণ' ইত্যাদি গ্রন্থের নামোল্লেখ করা যায়। তাঁর সম্পাদিত ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধান' গ্রন্থটি আমাদের লৌকিক ভাষার পরিচয় সন্ধানে এক অসামান্য গ্রন্থ হিসাবে চিরকাল সমাদৃত হবে। তাঁর সম্পাদিত ‘হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালায় সিদ্ধ কানুপার গীত ও দোহা' সম্পর্কে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান বলেন : ‘‘শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে যাবে, পৃথিবীর পরিবর্তন ঘটবে, কিন্তু শহীদুল্লাহ্র দোহাকোষ তার মূল্য হারাবে না।’’
(৫)
ভাষাতত্ত্বে তিনি ছিলেন উপমহাদেশের একজন স্বীকৃত ও সর্বজনমান্য পন্ডিত ব্যক্তি। প্রাচীন ও আধুনিক ভাষাসমূহের ইতিহাস, উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে তাঁর মতামতকে সকলে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ভাষাতত্ত্বের গবেষণায় তিনি শুধু উপমহাদেশেরই নয়, প্রাচ্য-গবেষকদের মধ্যেও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর গবেষণা ও মতামত বিশ্ব-বিদ্বজ্জন মহলে বিশেষভাবে সুপরিচিত ও সমাদৃত। ভাষার ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রচলিত মত মেনে নিয়েও যুক্তিসংগত কারণে তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। স্যার জন গ্রীয়ারসন, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং আরো অনেকের মতে, মধ্য-ভারতীয় আর্য ভাষার মধ্য স্তর মাগধী প্রাকৃত থেকে মাগধ অপভ্রংশ এবং তা থেকে প্রাচীন ‘বঙ্গকামরূপী' ভাষার উদ্ভব। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষাগত বিবর্তন ও বৈয়াকরণিক লক্ষণাদি বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বাংলা ভাষার জন্ম মাগধী প্রাকৃত ও মাগধ অপভ্রংশ থেকে নয়, বরং প্রাকৃত স্তরে গৌড়ী প্রাকৃত নামে যে ভাষা প্রচলিত ছিল, সে গৌড়ী প্রাকৃত থেকে গৌড় অপভ্রংশ ভাষার জন্ম এবং তা থেকে কালক্রমে বঙ্গকামরূপী ভাষার উদ্ভব ঘটে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এ মত প্রায় সকলেই যুক্তি-যুক্ত বলে মনে করেন। বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে তিনি বলেন :
‘‘বাংলা এবং পাক-ভারতীয় অন্যান্য আধুনিক ভাষা মূলত আদিম প্রাকৃত থেকে এসেছে, সংস্কৃত থেকে নয়। বাংলা ও উর্দ্দু ভাষায় এমন শব্দের প্রাচুর্য রয়েছে যাদের মূল সংস্কৃত নয়। যেমন ‘তুমি দেখো' কিংবা ‘তুম্ দেখো'। সংস্কৃতে এ হচ্ছে ‘ইয়ম পশ্য য'-এর কোন শব্দ থেকে ‘তুমি' বা ‘দেখ' আসেনি। এসেছে প্রাচীনকালের জনসাধারণের কথ্য ভাষা প্রাচীন প্রাকৃত থেকে ‘তুম্মে দেক্খ হ'। এ রকম বহু শব্দ ও বাক্য গঠন চোখে পড়ে বাংলা উর্দ্দু প্রভৃতিতে সংস্কৃতে যার মূল খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেমন: বড়, ছোট এগুলো সংস্কৃতের বৃহৎ বা ক্ষুদ্রের ভিন্নরূপ নয়, বরং আদিম প্রাকৃতের ‘বড্ড' ‘কষুট' কিংবা পরবর্তীকালে প্রাকৃত ‘বড্ড' ‘ছুটট' থেকে। এমনি ধ্বনিতত্ত্বের দিক দিয়েও বাংলা উর্দ্দুর জন্ম প্রাকৃতের কাছে যতটা ঋণী সংস্কৃতের কাছে ততটা নয়। সংস্কৃত ছিল দ্বিজ বর্ণের/ভাষার ভাষা, উচ্চ শ্রেণীর ধর্মীয় ও পোশাকী ভাষা-প্রাকৃত ছিল জনসাধারণের ভাষা, সেদিন পর্যন্ত সংস্কৃত তেমনি বেuঁচ ছিল- কিন্তু আদিম প্রাকৃত জনসাধারণের ভাষা হয়ে নানাভাবে পরিবর্তিত হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে নানারূপ গ্রহণ করে।’’
বাংলা ভাষার ইতিহাস রচনায় ডক্টর শহীদুল্লাহর অবদান অসামান্য। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎপত্তি ও বিকাশে মুসলমানদের ঐতিহাসিক অবদান সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু হিন্দু ঐতিহাসিকগণ অনেকে এতকাল পর্যন্ত ইচ্ছাকৃতভাবে এ ইতিহাস বিকৃত করেছেন, সত্য চাপা দিয়েছেন এবং মুসলমানদের অবদানকে বিকৃত বা অবমূল্যায়িত করেছেন। ডক্টর শহীদুল্লাহ এক্ষেত্রে সত্যসন্ধ গবেষকের দৃষ্টি নিয়ে অনেক অজানা, ভুলে যাওয়া এবং বিকৃত তথ্যের সঠিক মূল্যায়ন ও যথাযথভাবে তা উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন।
শিক্ষাবিদ হিসাবে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন এক প্রবাদতুল্য ব্যক্তি। ক্লাস রুমে বক্তৃতারত অবস্থায় তাঁকে মনে হতো যেন তিনি জ্ঞানের এক বিশাল ভান্ডার। ক্লাস রুম ছাড়াও সারা বাংলাদেশ জুড়ে বিভিন্ন শিক্ষায়তনে, সভা-সেমিনার, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মিলাদ মাহফিল, ওয়াজ মাহফিল ইত্যাদিতে তিনি সর্বশ্রেণীর শ্রোতার সামনে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করতেন।
(৬)
তিনি একজন ‘চারণ শিক্ষকে'র ভূমিকা পালন করেছেন। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পেলেও যথার্থ অর্থে তিনি ছিলেন আমাদের ‘জাতীয় শিক্ষক'। শিক্ষাবিদ হিসাবে তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি:
‘‘প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অভাব পাঁচটি- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। প্রথম চারটি তার জৈব ও সামাজিক অভাব, এদের অভাবে সে সমাজে জীবনধারণ করতে পারে না। কিন্তু শিক্ষার অভাবে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনও ভেদ থাকে না।’’
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন ঃ
‘‘আমি মনে করি শিক্ষার আদর্শ হচ্ছে VIM. V অর্থাৎ Vernacularization অর্থাৎ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা, এতে হবে মনের পরিপুষ্টি; I হলো Islamization অর্থাৎ ধর্মীয় শিক্ষা; এতে হবে আত্মার পরিপুষ্টি; M হলো Militarization অর্থাৎ সামরিক শিক্ষা, এতে হবে দেহের পরিপুষ্টি।’’
(৭)
ডক্টর শহীদুল্লাহর বাংলা ভাষা-প্রীতি সর্বজনবিদিত। তাঁর সারা জীবনের সাধনা, গবেষণা, লেখালেখি, সভা-সমিতি-বক্তৃতায় এর যথার্থতা প্রমাণিত। বাংলা ভাষাকে শিক্ষার বাহন, অফিস-আদালতের ভাষা ও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত করার জন্য তিনি সর্বদা সোচ্চার ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। এ সম্পর্কে তাঁর কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করছি :
এক. ১৯১৫ সনে কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মিলনীর সভাপতি হিসাবে ভাষণ দিতে গিয়ে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেন: ‘‘একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা সার্থক হতে পারে। ...চীন ও জাপানে যদি তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে আণবিক বিজ্ঞান শিক্ষা সম্ভব, তবে বাংলা ভাষাতেই বা তা হবে না কেন? তবে ইংরাজি, ফারসি, ল্যাটিন, জার্মান, রুশ ভাষা থেকে অনেক শব্দ আমাদের গ্রহণ করতে হবে- তা সবাই করেছে। ইংরাজি ভাষাতেও বহু বিদেশী শব্দ আছে।... এতে ভাষা শক্তিশালীই হবে।’’
দুই. বাংলা ১৩২৪ সনে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সমিতি'র বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন ঃ ‘‘আমরা বঙ্গদেশবাসী। আমাদের কথাবার্তার, ভয়-ভালবাসার, চিন্তা-কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ... মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষা কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া পরাণ আকুল করে? মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন্ ভাষার ধ্বনির জন্য প্রবাসীর কোন পিয়াসী থাকে? মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন্ ভাষায় কল্পনা-সুন্দরী তাহার মনমজান ভাবের ছবি অাঁকে?... সেদিন অতি নিকট, যেদিন বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভাষার স্থান অধিকার করিবে। বিদেশীয় ভাষার সাহায্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার মতন সৃষ্টি ছাড়া প্রথা কখনও টিকিতে পারে না।’’
তিন. ১৯১৮ সনে বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে ভবিষ্যৎ ভারতের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে মতামত গ্রহণের জন্য সর্বভারতীয় পর্যায়ে বিশিষ্ট পন্ডিতজনদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সকলেই হিন্দীর পক্ষে মতামত দিলেও সে সভায় উপস্থিত একমাত্র ডক্টর শহীদুল্লাহ দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন : ‘‘শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চে। ভাব-সম্পদ ও সাহিত্য-গুণে বাংলা ভাষা এশিয়ার ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে অদ্বিতীয়।’’
সেদিন ডক্টর শহীদুল্লাহর এ সত্যোচ্চারণে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ অনেকেই অগ্নিশর্মা হলেও শহীদুল্লাহ তাঁর যুক্তিসঙ্গত মতের উপর ছিলেন দৃঢ়-অবিচল। সততা, বলিষ্ঠতা ও সত্যোচ্চারণ ছিল জ্ঞান-তাপস ডক্টর শহীদুল্লাহর অন্যতম চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য।
চার. ১৯৪৭ সনের জুলাই মাসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস-চ্যান্সেলর ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে ডক্টর শহীদুল্লাহ তার কঠোর সমালোচনা করে ইংরাজি ‘দি কমরেড' পত্রিকায় 'The Language Problem of Pakistan’ এবং বাংলায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার সমস্যা' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন (২৯ জুলাই ১৯৪৭ তারিখে ‘দৈনিক আজাদে' প্রকাশিত)।
(৮)
ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আগ্রহ ও পান্ডিত্য ছিল গভীর। তিনি উদার ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেন। একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম হিসাবে তিনি পৃথিবীর সব বড় বড় ধর্মের সাথে তুলনামূলক বিচার করে ইসলামকেই শ্রেষ্ঠ ধর্ম মনে করতেন। তবে সর্বক্ষেত্রে পরমতসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করা ছিল তাঁর অন্যতম চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য। ইসলামী বিষয় নিয়ে লেখা তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ তাঁর এ নিষ্ঠাপূর্ণ, অনুসন্ধিৎসূ ধর্মীয় আবেগেরই প্রমাণ বহন করে। এ কারণে অনেকের নিকট তিনি ধর্মগুরু হিসাবেও বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।
(৯)
সাহিত্য ক্ষেত্রে ডক্টর শহীদুল্লাহর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। বড়দের জন্য, শিশুদের জন্য তথা সর্বশ্রেণীর পাঠকের জন্যই তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন। অনুবাদের ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তাঁর রচিত গ্রন্থের তালিকা থেকে এটা প্রতীয়মান হয়। বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্য-পুস্তক রচনার ক্ষেত্রেও তাঁর কৃতিত্ব ছিল তুলনাহীন। ডক্টর সুকুমার সেন বলেন : ‘‘ডক্টর শহীদুল্লাহ্ শব্দবিদ্যাবিদ ছিলেন, সেই সঙ্গে সাহিত্যিকও ছিলেন। তিনি চমৎকার ঝরঝরে বাংলা লিখতেন এবং তাঁর প্রসন্ন সাহিত্যবোধও ছিল।’’ এ সংক্ষিপ্ত মন্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা সাহিত্যিক হিসাবে ডক্টর শহীদুল্লাহ্র যথার্থ পরিচিতি খুঁজে পাই।
(১০)
আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ধর্ম, দর্শন, জাতীয় জাগরণ ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডক্টর শহীদুল্লাহর অবদান অসামান্য। বিংশ শতাব্দীর উন্মেষ-লগ্ন থেকে প্রায় সাত দশক কাল পর্যন্ত তিনি এসব ক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তার ফলে জাতি নানাভাবে সমৃদ্ধ ও উপকৃত হয়েছে। জাতীয় শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, গবেষণা ও মনন-চর্চার ক্ষেত্রে সকলের নিকট তিনি ছিলেন এক অনুকরণীয় অনন্য আদর্শ। যেসব মহান ব্যক্তির নিকট জাতি নানাভাবে চিরদিন ঋণী ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ।
১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পাশে সমাহিত করা হয়। ভাষাক্ষেত্রে তাঁর অমর অবদানকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদুল্লাহ হল।
Moving Encyclopedia of Bangladesh খ্যাত এই প্রাজ্ঞজনকে আমি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
Khalid
১০ জুলাই ২০১৮


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন