বৃহস্পতিবার, ১২ জুলাই, ২০১৮

ব্যাটারি আবিষ্কার







ব্যাটারি আবিষ্কার


ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন                প্রণব কুমার কুণ্ডু



Misti Sarmistha


ভোল্টা-গ্যালভানি দ্বন্দ্ব ও ব্যাটারির উদ্ভাবন

বিদ্যুতের ইতিহাসে দ্বন্দ্বের কথা বলতেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে নিকোলা টেসলা ও টমাস আলভা এডিসনের দ্বন্দ্বের কথা। ডিসি কারেন্ট ও এসি কারেন্ট নিয়ে এ দুজন উদ্ভাবকের দ্বন্দ্ব ‘দ্য ওয়ার অফ ইলেক্ট্রিসিটি’ নামে ইতিহাস-বিখ্যাত হয়ে আছে। তবে বিদ্যুৎ নিয়ে মহারথীদের দ্বন্দ্ব সেবারই প্রথম নয়, এরও বহু আগে নিজেদের আবিষ্কার নিয়ে আরো দুজন বিজ্ঞানী এমন বিতর্কে জড়িয়েছিলেন।

লুইজি গ্যালভানি ও আলেসান্দ্রো ভোল্টা, নাম দুটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। বিদ্যুৎ নিয়ে কাজের জন্য ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন দুজনই। নিজেদের আবিষ্কার নিয়ে পারস্পারিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন তারাও। তবে তাদের দ্বন্দ্ব তো আর বাকী দশজনের মতো কুৎসিত হতে পারে না, সেখান থেকেও বেরিয়ে আসে অসাধারণ সব উদ্ভাবন। ভোল্টা ও গ্যালভানির দ্বন্দ্ব থেকে জন্ম হয়েছিল তড়িৎকোষ বা ব্যাটারির। সে গল্পই বলা হবে আজকের লেখায়। তাহলে একদম শুরু থেকে শুরু করা যাক।

১৭৫৭ সালের দিকে একজন ফরাসি উদ্ভিদবিজ্ঞানী দক্ষিণ আমেরিকায় ঘুরতে গিয়ে এক নতুন ধরনের ক্যাটফিশ লক্ষ্য করেন। এটিকে স্পর্শ করতেই ইলেকট্রিক শকের মতো একধরনের অনুভূতি টের পান তিনি। ১৭৭২ সালে ভারতে কর্মরত একজন বৃটিশ কর্মকর্তা একই ধরনের অন্য একটি মাছ আবিষ্কার করেন। তিনি একধরনের ইল মাছ দেখতে পান, যার শরীর সম্পূর্ণরূপে চার্জযুক্ত। এ মাছটি নিজের ত্বকের ওপর প্রবাহমান বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গও তৈরি করতে পারতো।

এসকল আবিষ্কারের ফলে বেশ কয়েকজন গবেষক ভাবতে শুরু করেন যে, “কিছু প্রাণীর শরীরে কিংবা হয়তো সকল প্রাণীর শরীরেই বিদ্যুৎ শক্তি জমা থাকে।” এর আগে মানুষ কেবল জানতো যে প্রাণীদেহ খুব দ্রুত বিদ্যুৎ পরিবহণ করতে সক্ষম, কিন্তু শরীরে চার্জ সংরক্ষণ ও তা কাজে লাগানোর নতুন ধারণাটি মানুষকে ভীষণ কৌতূহলী করে তোলে। অনেকেই ‘এনিম্যাল ইলেকট্রিসিটি’ নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করেন। এ গবেষকদের মধ্যেই একজন ছিলেন ইতালির বোলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমির অধ্যাপক লুইজি গ্যালভানি।

গ্যালভানি বিদ্যুতের বিষয়টি প্রথম লক্ষ্য করেন ব্যাঙ ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে। ব্যবচ্ছেদ করার জন্য তিনি একটি ব্যাঙকে তামার প্লেটে রাখতেন, এরপর দস্তার তৈরি ক্লিপ দিয়ে এটিকে আঁটকে রাখতেন প্লেটের সাথে। একদিন তিনি লক্ষ্য করলেন, যখনই একটি সদ্য কাটা ব্যাঙের শরীরে দস্তার ক্লিপটি স্পর্শ করছে, তখনই ব্যাঙটির পাগুলো ঝাঁকি খেয়ে উঠছে। অনেকটা বৈদ্যুতিক শক পাওয়া কারো শরীরের মতো। তিনি ধারণা করেন যে, ব্যাঙের পেশিতে থাকা তরলই এনিম্যাল ইলেক্ট্রিসিটি জমা করে রাখে এবং তিনি তার এ তত্ত্ব প্রকাশ করেন।

গ্যালভানির তত্ত্বটি প্রকাশ হওয়ার পর বিজ্ঞানী মহলে এটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানীদের আড্ডায় পছন্দের তর্কের বিষয় হয়ে ওঠে এটি। এ তত্ত্বের বিরোধীতাও করেন বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী। এ বিরোধী বিজ্ঞানীদের একজনই ছিলেন, গ্যালভানির প্রাক্তন সহকর্মী ও বন্ধু আলেসান্দ্রো ভোল্টা। মিথেন গ্যাস আবিষ্কারের জন্য ভোল্টা ততদিনে বেশ বিখ্যত। ভোল্টা বলেন, ব্যাঙটি যে বৈদ্যুতিক শক পেয়েছে তা এর তরলে জমা থাকা বিদ্যুতের জন্য নয়। দুটি ভিন্ন ধাতু, তামা ও দস্তার মধ্যকার বিক্রিয়ার ফলেই এ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়েছে।

এদিকে গ্যালভানিও তার তত্ত্বে অনড় থাকলেন। এ ঝামেলা বেশ পাকিয়ে ওঠে যখন দুজনেই জনসম্মুখে একে অপরের সমালোচনা করতে শুরু করেন। সময়ের সাথে এ বিতর্ক এতটা তীব্র হয়ে ওঠে যে, দুই বন্ধু সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। গ্যালভানি পরবর্তীতে দেখান যে, তিনি যদি ব্যাঙকে স্পর্শ করতে কেবল একধরনের ধাতু ব্যবহার করেন তা-ও ব্যাঙের শরীর ঝাঁকি খেয়ে ওঠে। ভোল্টাও হার মানবার পাত্র নয়। তিনিও নিজের তত্ত্ব প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগলেন। দেখাতে চেষ্টা করলেন যে, ব্যাঙ নয়, ধাতুর মধ্যকার বিক্রিয়াই বিদ্যুৎ শক্তির জন্ম দেয়।

অবশেষে ১৮০০ সালের মার্চের দিকে ভোল্টা সফল হন। কেবলমাত্র বিভিন্ন ধাতুর সংযোগের মাধ্যমে একটানা বিদ্যুৎ প্রবাহ উৎপন্ন করতে সক্ষম হন তিনি। এক্ষেত্রে কোনো ব্যাঙের প্রয়োজন হয়নি তার। তখন তার ভোল্টায়িক পাইল ছিল পুরো পৃথিবীকে চমকে দেয়ার মতো উদ্ভাবন। এ ডিভাইসটির গঠন কিন্তু তেমন বেশি জটিল কিছু ছিল না। কিছু পাতলা দস্তা ও রূপার পাত একের পর এক সাজান তিনি। এবং পরপর দুটি পাতের মাঝখানে দিয়ে দেন নোনা জলে সিক্ত ফেল্টের কাপড় অথবা একধরনের শক্ত কাগজ। ব্যাস, তৈরি হয়ে গেল ভোল্টার তড়িৎকোষ!

ভোল্টা এর নাম দেন ‘কৃত্রিম বৈদ্যুতিক অঙ্গ’। এটি বিদ্যুৎ উৎপন্ন ও জমা করে রাখতে সক্ষম ছিল। এর একদম উপরের দস্তার চাকতির সাথে নিচের রূপার চাকতিকে কোনো তামার তারের মাধ্যমে সংযুক্ত করলে তারটির মধ্য দিয়ে একটানা বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতো। গ্যালভানি ভোল্টার এ আবিষ্কারের বছরখানেক পূর্বেই মারা গিয়েছিলেন, তাই এ উদ্ভাবনটি দেখে আবার বিতর্ক শুরু করার সুযোগ আর পাননি।

ভোল্টায়িক পাইল কেন এত গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ছিল? কারণ এটি পূর্বেকার বিদ্যুৎশক্তির উৎসগুলোর তুলনায় অনেক বেশি উন্নত উদ্ভাবন ছিল। এর পূর্বে বিদ্যুতের উৎস বলতে ছিল লেইডেন জার, যা মূলত একটি ক্যাপাসিটর। এটি এক লহমায় সম্পূর্ণ ডিসচার্জ হয়ে যেত। কিন্তু ভোল্টায়িক পাইল, যাকে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন পরে ‘ব্যাটারি’ নাম দেন, তা লাগাতার বৈদ্যুতিক প্রবাহ সরবরাহ করতে সক্ষম ছিল। তাছাড়া ব্যাটারির উৎপাদন করা বিদ্যুতের পরিমাণও ছিল লেইডেন জারের তুলনায় অনেক বেশি। এ প্রবাহ ছিল অনেক বেশি স্থিতিশীল ও হিসেব করে পরিমাণ মতো নিয়ন্ত্রণ করা যেত।

বৈজ্ঞানিক গবেষণার নীতি মেনে ভোল্টা ব্যাটারির সম্পূর্ণ ডিজাইন একটি গবেষণাপত্রে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করে দেন। এরপর খুব শীঘ্রই গোটা ইউরোপজুড়ে গবেষকরা ভোল্টার ডিজাইনকে নকল করতে শুরু করেন, এটিকে আরো উন্নত করার জন্যেও কাজ করেন অনেকে। ভোল্টার এ ডিজাইনটি ছিল একদমই সরল। বেশ অল্প খরচেই এটি তৈরি করা সম্ভব ছিল, বিশেষ করে যখন তিনি দেখান যে এতে রূপার চাকতির বদলে তামাও ব্যবহার করা সম্ভব।

তার ব্যাটারির আরো একটি অসাধারণ সুবিধা ছিল, যদি কারো বেশি বৈদ্যুতিক বিভব শক্তির দরকার হতো, তবে সে সহজেই একটি ব্যাটারির সাথে অন্যটি জুড়ে দিতে পারতো। বেশি বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য, এতে ব্যবহারিত চাকতিগুলোর ক্ষেত্রফল বাড়িয়ে নেয়া যেত, অনেকগুলো ব্যাটারিকে সমান্তরালে সংযুক্ত করে দেয়া যেত। বলা যায় ব্যাটারির উদ্ভাবনের সাথে মানবজাতি অবশেষে একটি নির্ভরশীল, লাগাতার বিদ্যুৎ শক্তি সরবরাহ করার মতো উৎস পেল।

ব্যাটারি আবিষ্কারের পর ভোল্টা যশ-খ্যাতির চূড়ায় আরোহন করেন। দুনিয়াজুড়ে তার আবিষ্কারের বন্দনা চলতে থাকে। দিগ্বিজয়ী ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তাকে বিশেষ অনুরোধ জানান ব্যাটারির কৌশল তার কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য। ভোল্টা তাকে ব্যাটারি ব্যবহার করে বিদ্যুতের জাদু প্রদর্শন করেন। তিনি নেপোলিয়নকে দেখান, ব্যাটারির মাধ্যমে তিনি একটি লোহাকে গনগনে লাল ও আগুনের মতো গরম করে ফেলতে পারেন, এর তারকে জলের মধ্যে চুবিয়ে তৈরি করতে পারেন বুদবুদ। নেপোলিয়ন বিদ্যুতের খেলা দেখে মুগ্ধ হন এবং ভোল্টাকে তিনি প্যারিসে একটি রাজকীয় পদে দায়িত্ব নিতে আহ্বান জানান, অবশ্যই বেশ ভালো পরিমাণ বেতন সহ। ভোল্টাও খুশিমনে তা গ্রহণ করে নেন।

এরপর থেকে ভোল্টা তেমন গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো গবেষণা করেননি, তবে এক ব্যাটারির উদ্ভাবনই তাকে কিংবদন্তীতে পরিণত করেছে। এমনকি আজও তার স্বদেশীরা তাকে বেশ শ্রদ্ধার সাথেই স্মরণ করে। তার স্মৃতির সংরক্ষণার্থে ইতালির কোমো হ্রদের কোল ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে অনিন্দ্য সুন্দর ভোল্টা মন্দির। ইতিহাসে খুব কম সংক্ষক বিজ্ঞানী বা ইঞ্জিনিয়ার ভোল্টার মতো সম্মাননা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন।


তথ্যসূত্র: Conquering the Electron by Derek Cheung , Eric Brach , page (16-19)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন