মঙ্গলবার, ১৭ জুলাই, ২০১৮

গপ্পের গল্প


    গপ্পের গল্প


     ফেসবুক থেকে       শেয়ার করেছেন        প্রণব কুমার কুণ্ডু



রূপকথা আর কল্পনার ইতিহাস
=======================
আলি আসগর চিস্তি জুয়াহারি ফরিদী লাহোরির লেখনী অনুযায়ী আজমীরের খাজা মঈনউদ্দিন চিস্তি ছিলেন এক মহান আর অমিত ক্ষমতাধর সুফি দরবেশ। তিনি নাকি নিজের অলৌকিক ক্ষমতাবলে প্রায় একার হাতে দিল্লি-আজমীরের অন্তিম হিন্দু সম্রাট পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করে ভারতের মাটিতে ইসলাম ধর্মের প্রসার করেছিলেন। নিচে দেওয়া হলো আলি আসগরের লেখার সারাংশ।
খ্রিষ্টাব্দের প্রথমার্ধ। আফগানিস্থানের ঘুর সাম্রাজ্যের রাজধানী গজনীর দরবারে এসে উপস্থিত হলো এক দরবেশ ফকির। গজনীর মসনদে তখন আসীন সুলতান শিহাবউদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। তুর্কি সুলতানের নিকট সেই ফকির আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। কি কারণে তিনি গজনী এসেছেন জানতে চাইলেন সুলতান। জবাবে ফকির জানালো যে তার নাম মঈনউদ্দিন হাসান। তার জন্ম ১১৪১ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের সঞ্জর নামক স্থানে। তাঁর পিতার নাম খাজা গিয়াসুদ্দীন আর মায়ের নাম মাহ্নূর। নবী হজরত মহম্মদের এক শিষ্য। স্বয়ং পরমেশ্বর আল্লাহর নির্দেশ তিনি পৌত্তলিক ধর্মাবলম্বী কাফের ভূমি হিন্দুস্থানে ইসলাম ধর্মের প্রচার আর প্রসারে এসেছেন। কিন্তু সুলতানের সাহায্য ব্যতীত তার একার পক্ষে এই মহান কার্যে সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয়। এরপর ফকির মঈনউদ্দিন হাসানের নানান অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ সুলতান ঘোরী তাকে গজনীর কেল্লায় আশ্রয়দান করলেন।
সেই বছরেরই অন্তিম লগ্নে কাফের ভূমি হিন্দুস্তানে হামলার ছক কষলেন মহম্মদ ঘোরী। সেই সংবাদ পেয়ে ফকির মঈনউদ্দিন সুলতানকে নিষেধ করে বললেন যে তার গণনা অনুসারে হিন্দুস্থান আক্রমণের সঠিক সময় এখনও আসেনি। কিন্তু ফকিরের নিষেধ অগ্রাহ্য করে ভারতে সেনা অভিযান চালালেন ঘোরী। রাজস্থানের মাউন্ট আবুর পাদদেশে কায়দারা গিরিঘাটের যুদ্ধে গুজরাটের সোলাঙ্কি বাহিনীর শৌর্য আর পরাক্রমের সম্মুখে শোচনীয় ভাবে পরাজিত ও বিধ্বস্ত হলেন তুর্কি অধিপতি ঘোরী। কোনোমতে প্রাণ রক্ষা করে পালিয়ে বাঁচলেন। এরপর ফকিরের প্রতি তার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হলো।
গজনীর দরবারে ফকির পরাজিত সুলতানকে জানালেন যে হিন্দুস্থানে অনুপ্রবেশ করবার সবচেয়ে উত্তম স্থান হলো উত্তর-পশ্চিমের দিল্লি আর আজমীর নগর। তবে সুলতানের আক্রমণের পূর্বে তিনি নিজে আজমীরে গিয়ে ওখানকার কাফেরদের হালচাল স্বচক্ষে দেখতে চান। অনুমতি দান করলেন সুলতান। জনাকয়েক শিষ্য সমেত হিন্দুস্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন ফকির মঈনউদ্দিন।
১১৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগে শিষ্য সমেত আজমীর নগরের মূল প্রবেশপথের সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন মঈনউদ্দিন হাসান। পথিকদের বেশভূষা আর আচার আচরণ দেখে নগরের দ্বার রক্ষীরা মুহূর্তের মধ্যে বুঝে গেলেন যে আগন্তুকগণ পশ্চিম প্রান্তের যবন লুন্ঠক ভূমির অধিবাসী। এরপর আজমীর নগরে ফকির আর তার সাথীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করলেন তাঁরা। কিন্তু রাত নামলে নিজের সম্মোহন বিদ্যার পরিচয় দিয়ে জাদুকর ম্যানড্রেকের ন্যায় আজমীরের দ্বার রক্ষীদের নিস্তেজ করে অবশেষে বিনা বাধায় সমৃদ্ধশালী আজমীর নগরে প্রবেশ করলেন ফকির। সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা আর অগুনতি সমৃদ্ধশালী সুউচ্চ প্রাচীন মন্দিররাজি দ্বারা বেষ্টিত কাফের ভূমি আজমীর প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ করলো ফকিরকে। তিনি মনে মনে শপথ নিলেন দার-উল-হার্ব হিন্দুস্থানকে পবিত্র দার-উল-ইসলামে পরিণত করার শুভ কার্য্য শুরু করবেন এই আজমীর নগর থেকেই।
এরপর ফকির তার শিষ্যদের নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন বিখ্যাত চৌহান নৃপতি আর্নোরাজ চৌহান দ্বারা সৃষ্ট সুবিশাল নয়নাভিরাম আনাসাগর হ্রদের এক প্রান্তে। সেই সময় আনাসাগর হ্রদের দুই প্রান্ত সজ্জিত ছিল অগুনতি সমৃদ্ধশালী সুউচ্চ মন্দিররাজি দ্বারা। প্রতিদিন ঘন্টা ধ্বনি আর প্রভাতী সঙ্গীত আর মঙ্গল আরতির সুরেলা আওয়াজের সাথে সাথে আনাসাগর হ্রদে দিনের শুরু হতো আর সন্ধ্যা আরতি ও শঙ্খনাদের সাথে সাথে দিনের শেষ হতো। প্রথমদিকে ফকির আর তার শিষ্যরা হ্রদ থেকে আনা জল পান করতেন, খাসী আর হরিণের মাংস ভক্ষণ করতেন আর চারপাশে নজর রাখতেন। ফকির তার অলৌকিক সাধনা বলে জানতে পারলেন আজমীর আর দিল্লির বর্তমান শাসক এক দুরাচারী, উদ্ধত ও অত্যাচারী রাজপুত বংশীয় কাফের যুবক। নাম তাঁর পৃথ্বীরাজ চৌহান। তিনি নাকি ঘোরতর ইসলাম বিরোধী আর অসহিষ্ণু এক সাম্প্রদায়িক শাসক। এরপর ফকির মনে মনে শপথ নিলেন দুরাচারী পৌত্তলিক পৃথ্বীরাজকে অধর্মের পথ থেকে ধর্মের পথে আনবার।
ফকিরের কেরামতিতে অসুস্থ পৃথ্বীরাজের উট বাহিনী
=====================================
এক রাতে আনাসাগর হ্রদের প্রান্তে এক সুউচ্চ বরাহদেব মন্দিরের প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হলেন ফকির আর তার শিষ্যরা। সেখানে তারা অগ্নি সংযোগ করে স্থানীয় এক অধিবাসীর গোশালা থেকে চুরি করে আনা এক গরুকে জবাই করে মৃত গরুর মাংস আগুনে ঝলসে সবাই মিলে তারিয়ে তারিয়ে ভক্ষণ করলেন। পরেরদিন প্রত্যুষে মঙ্গল আরতির সময় মন্দির প্রাঙ্গণ অপবিত্র দেখে যারপরনাই রুষ্ট হলেন মন্দিরের গোঁড়া আর ভণ্ড পুরোহিত গণ। তাঁদের যাবতীয় সন্দেহ গিয়ে পড়লো যবন ফকির আর তার সাগরেদদের উপর। নালিশ গেল নগর কোটাল হরিরাজ চৌহানের নিকট। তাঁর নির্দেশে সশস্ত্র সিপাহী সমেত মন্দিরের মারমুখী পুরোহিত গণ আর জনতা ধেয়ে এলো ফকিরের বাসস্থানে। কিন্তু তাঁরা এসে দেখলেন পাখি ফুড়ুৎ।
নিজের গণনায় এই ঘটনার কথা আগাম জানতে পেরে নিজের বিশেষ ক্ষমতাবলে ফকির আর তার সাগরেদরা পূর্বেই অদৃশ্য হয়েছিলেন। নিজেদের বাসস্থানে অদৃশ্য অবস্থায় সব দেখলেন তারা। পুরোহিতদের উস্কানিতে উন্মত্ত জনতা তছনছ করলো নিরীহ ফকিরের বাসষ্ঠান। এরপর পৃথ্বীরাজের সিপাহীরা তাদের বাসস্থান সিল করে দিয়ে বিদায় নিল। সামান্য গোমাংস খাবার অপরাধে তার বাসস্থান লণ্ডভণ্ড করে দিলো ধর্মন্মাদ পৃথ্বীরাজের সিপাহীরা। এরপর ক্রুদ্ধ ফকির শপথ নিলেন গতকাল রাতে বরাহদেবের যেই মন্দির প্রাঙ্গণে বসে নৈশভোজ সম্পন্ন করেছিলেন তারা অদূর ভবিষ্যতে সেই মন্দিরকেই পরিণত করবেন তার দরগায়।
এরপর প্রতিশোধের পালা। দিন দুই পরে ফকিরকে দেখা গেল আজমীর নগরের মূল রাজপ্রাসাদের পেছনে দিল্লি নরেশের সেনা ছাউনির একাংশে উট শালার সম্মুখে মাটির উপর একখণ্ড বস্ত্র পেতে বসে নামাজ পাঠ করতে। সেই সময় নামাজ পাঠ আর আজান সম্বন্ধে কোন সম্যক ধারণা ছিল না ভারতবাসীর। সিপাহীরা ফকিরকে অদ্ভুত আচরণ করতে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে ধেয়ে এলো তার নিকটে। অবিলম্বে উটশালা ত্যাগ করে চলে যাবার নির্দেশ দেওয়া হলো ফকিরকে। ফকির তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বললো যে তিনি ওই স্থান ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন বটে তবে দাম্ভিক রাজার উটশালার একটাও উট আর যুদ্ধের জন্য সুস্থ থাকবে না। এই বলেই মুহূর্তের মধ্যে বাতাসে মিলিয়ে গেল ফকির। এরপর প্রায় সাথে সাথেই দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। রাজার উটশালার যাবতীয় উট ভূমি শয্যা গ্রহণ করলো। কোন চিকিৎসক তাদের সুস্থ করতে পারলেন না। এই অদ্ভুত দৃশ্যের সম্মুখীন হয় বাকরুদ্ধ আর মুহ্যমান হয়ে পড়লেন সিপাহীরা। বিদ্যুতের গতিতে সংবাদ পৌঁছল দিল্লিতে স্বয়ং পৃথ্বীরাজ চৌহানের দরবারে। তিনি নিজে দিল্লি থেকে বিশেষ পশু চিকিৎসকদের নিয়ে এলেন আজমীরে। কিন্তু উটদের সুস্থ করতে ব্যর্থ হলেন তারাও। এরপর অমাত্যদের পরামর্শে পৃথ্বীরাজ নিজে দেখা করতে বাধ্য হলেন ফকিরের সাথে। ফকিরের কাছে নিজের সেনাবাহিনী আর পুরোহিতদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তারপর ফকিরের মন্ত্রবলে মুহূর্তের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠলো উটশালার যাবতীয় উট।
আনাসাগর হ্রদকে নির্জলা করলেন ফকির
============================
তুর্কি ফকিরকে উচিত শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়ে ক্রোধে ফুঁসছিলেন আনাসাগর তটের মন্দিররাজির পুরোহিতগণ। তাঁরা এবারে আজমীরের প্রাসাদে গিয়ে সেখানে উপস্থিত পৃথ্বীরাজের নিকট ধর্ণা প্রদর্শন করে জানালেন যে গোমাংস ভক্ষণকারী যবন ফকিরের স্পর্শে অপবিত্র আর কলুষিত হচ্ছে আনাসাগর হ্রদ। এরপর ক্রুদ্ধ পৃথ্বীরাজ তৎক্ষণাৎ ফকির আর তার সাগরেদদের আনাসাগর হ্রদের জলপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রক্ষী মোতায়েন করলেন হ্রদের চারদিকে। অলৌকিক শক্তিবলে রাজার সেই অমানবিক আর নিষ্ঠুর নির্দেশের কথা জানতে পারলেন ফকির। সে রাতেই ক্রুদ্ধ ফকির একটি লোটা সমেত উপস্থিত হলেন আনাসাগর হ্রদের পাড়ে। ফকিরকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো এক রক্ষী। সেই রক্ষীটি রুক্ষ কণ্ঠে ফকিরকে রাজ নির্দেশ জানিয়ে অবিলম্বে হ্রদ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু ফকির পালিয়ে না গিয়ে এক জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন রক্ষীর উদ্দেশ্যে। মুহূর্তের মধ্যে হৃদ যন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লেন সেই কাফের রক্ষী। এরপর লোটা পূর্ণ করে আনাসাগর হ্রদ থেকে জল নিয়ে এলেন ফকির।
পরেরদিন ভোরে দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। জলশূন্য হয়ে পড়েছে সুবিশাল আনাসাগর হ্রদ। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে হ্রদের তলদেশ। সমগ্র আজমীর নগরীর জলাধার এই হ্রদ। অতএব মুহূর্তের মধ্যেই হাহাকার পরে গেল নগর জুড়ে। সংবাদ গেল স্বয়ং রাজার নিকটে। বিপন্ন পৃথ্বীরাজ তাঁর সেনাপতিকে ফকিরের নিকটে পাঠিয়ে পুনরায় ক্ষমা চাইলেন এবং নিজের নির্দেশ প্রত্যাহার করলেন। ফকিরের দয়ার শরীর। তিনি ক্ষমা করলেন দাম্ভিক আর অত্যাচারী রাজাকে। এরপর শুষ্ক হ্রদে গিয়ে নিজের লোটার জল হ্রদে ঢালতেই পুনরায় জলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো সমগ্র হ্রদ। ফকিরের এই অদ্ভুত ক্ষমতার পরিচয় লাভ করে মুগ্ধ হলো অসংখ্য আজমীর বাসী। অনেকেই ফকিরের নিকটে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন।
জাদুকর অজয়পালকে পরাজিত করলেন ফকির
==============================
ইতিমধ্যেই ফকিরের কেরামতিতে এক বাছুরের বাঁট দুধে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো, এক নিঃসন্তান রমণী গর্ভবতী হলো, প্রবল খরার মধ্যেও তুমুল বৃষ্টিপাত হলো আর স্থানীয় এক শনি মন্দিরের বিগ্রহে কলমা লেপন করে সেই বিগ্রহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাকে মনুষ্য রূপ দান করলো ফকির। মনুষ্য রূপী শনিদেবের নতুন নামকরণ হলো শাদি মহম্মদ। ফকিরের অলৌকিক ক্ষমতার বহর দেখে আজমীরের চমৎকৃত অধিবাসীরা কাতারে কাতারে ফকিরের ঠেকে এসে ঘৃণ্য আর মেকি পৌত্তলিক ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো।
এই সংবাদ এসে পৌঁছল দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহানের নিকট। শয়তান, দাম্ভিক আর অমানবিক রাজা তাঁরই নিজরাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী নগরে ফকিরের দ্বারা অবাধ ধর্মান্তকরণের সংবাদ শুনে যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে ফকির আর তার চ্যালাদের ভবলীলা সাঙ্গ করবার জন্য পাঁচশত সেনার এক ঘাতক বাহিনী প্রেরণ করলেন আজমীরে। পৃথ্বীরাজের সেনারা ফকিরের থানে পৌঁছেই তাকে হত্যা করবার জন্য উন্মুক্ত তরবারি হস্তে হারে রে রে করে তেড়ে এলেন। কিন্তু ফকির দ্রুত একমুঠো ধুলো কুড়িয়ে নিয়ে মন্ত্র পাঠ করে তা সজোরে নিক্ষেপ করলেন ঘাতক বাহিনীর দিকে। মন্ত্রপূত ধূলোর আঘাতে বহু সেনা তৎক্ষণাৎ অন্ধ হয়ে গেল, অনেকে সংজ্ঞাহীন হলো আর অবশিষ্ট সেনারা তীব্র আতঙ্কে ফকিরের থান ত্যাগ করে চম্পট দিলো।
উপর্যুপরি পরাজয়ের সংবাদ শুনে এবারে কিছুটা সন্ত্রস্ত হলেন দিল্লি-আজমীরের কাফের রাজা। একদিকে এক সামান্য যবন ফকিরের কাছে বারবার পরাজয়ের জ্বালা, অপরদিকে ফকিরের ধর্মান্তকরণ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দিল্লি-আজমীরের পুরোহিত কুলের তীব্র ভৎসনা, এই যুগপৎ আক্রমণের সম্মুখে এবারে যেন কিছুটা সন্ত্রস্ত দেখালো দাম্ভিক পৌত্তলিক রাজাকে। ধর্ম রক্ষা করে যবন ফকিরকে তাঁর রাজ্য থেকে চিরতরে উৎখাতের জন্য রাজা ডেকে পাঠালেন তাঁর মামা তথা আজমীরের বিখ্যাত জাদুকর অজয়পাল চৌহানকে। তন্ত্র সাধনা, কালাজাদু আর যোগ সাধনায় অসাধারণ পারদর্শী ছিলেন অজয়পাল। দিল্লির প্রাসাদে এসে ভাগ্নে পৃথ্বীরাজের মুখে সব শুনে মুহ্যমান রাজাকে সান্তনা দিয়ে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন ফকিরের যাবতীয় কেরামতি শেষ করবার।
পরবর্তী অমাবস্যার রাতে অজয়পাল তাঁর যাবতীয় ভূত-প্রেত আর পিশাচদের নিয়ে লর্ড অফ দা রিংস চলচ্চিত্রের মতো ড্রাগন পাখির পৃষ্ঠে আরোহণ করে রওনা দিলেন ফকিরের আস্তানার দিকে। এবারেও যথারীতি বিশেষ ক্ষমতাবলে আগে থেকেই অজয়পালের আগমনের সংবাদ শুনে ফকির তার আস্তানার চতুর্দিকে একটি গণ্ডি অঙ্কিত করলেন। এরপর নিষ্ঠাভরে আজানের আরবিক মন্ত্র উচ্চারণ করে নিজের চেলাদের বারবার সাবধান করলেন কোন পরিস্থিতিতেই গণ্ডি অতিক্রম না করতে। যথাসময়ে অজয়পাল এসে উপস্থিত হলেন ফকিরের আস্তানার সম্মুখে। নিজের ভূত-প্রেত, পিশাচ আর ড্রাগন বাহিনী সমেত তীব্র আক্রমণ শানালেন। কিন্তু অজয়পালের কোন অস্ত্রই ফকিরের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারলো না। এরপর ক্রুদ্ধ অজয়পাল ফকিরের আস্তানা লক্ষ্য করে ইন্দ্রের ন্যায় বজ্র ছুঁড়ে মারলেন। সেই বজ্র ফকিরের আস্তানায় প্রবেশ করতে না পেরে উল্টোদিকে ধেয়ে এসে আছড়ে পড়লো অজয়পালের উপরই। শেষে আহত, বিরক্ত আর ক্রোধন্মত্ত অজয়পাল এক উড়ুক্কু আসনের উপর বসে আকাশের উপর উড়ে গিয়ে গণ্ডি অতিক্রম করে ফকিরকে আক্রমণ করার চেষ্টা করলেন। সাথে সাথে ফকিরও শূন্যে ছুঁড়ে মারলো তার পাদুকাদ্বয়। সেই পাদুকা জোড়া অন্তরীক্ষে উঠে সোজা অজয়পালের মাথায় ক্রমাগত বাড়ি মারতে লাগলো। অবশেষে ফকিরের অলৌকিক পাডুকার আঘাত খেয়ে মাটিতে ধরাশায়ী হলেন অজয়পাল।
পরাজিত অজয়পাল কালো মুখে ফিরে গেলেন দিল্লি। পৃথ্বীরাজ তাঁর মামার উপর ভয়ানক রুষ্ট হয়ে তাঁকে নিজ রাজ্য থেকে অপসারিত করলেন। ভাগ্নের বিশ্বাসঘাতকতায় ক্রুদ্ধ অজয়পাল সোজা এসে শরণ নিলেন ফকিরের পদতলে। ফকিরের পরামর্শে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তার নতুন নাম হলো আবদুল্লা বায়াবনী। এরপর ফকির অজয়পাল ওরফে আবদুল্লার মাধ্যমে পুনরায় দিল্লিতে পৃথ্বীরাজের নিকট সংবাদ পাঠিয়ে রাজাকে স্নেহভরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু এবারেও ফকিরের সেই অনুরোধ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে উল্টে নিজের ধর্মান্তরিত মামা আবদুল্লাকেই তীব্র অপমানিত করে দিল্লির দরবার থেকে ভাগিয়ে দিলেন অত্যাচারী পৃথ্বীরাজ। সব শুনে জ্বলন্ত অঙ্গারের ন্যায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রুদ্ধ ফকির ঘোষণা করলো, “দাম্ভিক কাফের রাজা তোমার পাপের ঘরা পূর্ন হয়েছে। আমাকে নয় স্বয়ং আল্লাহকে অপমানিত করে ঘোরতর অন্যায় করেছো তুমি। তুমি আর কখনও পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে না। তোমার দম্ভ চূর্ণ করতে তোমার সমগ্র রাজ্য আমি ঘুরের সুলতান মহম্মদ ঘোরীকে সমর্পিত করলাম, আর সেই সাথে অভিশাপ দিচ্ছি তোমায়, তোমার রাজ্য আর মেকি ধর্ম ধ্বংস করে এখানে পরমেশ্বর আল্লাহর ধর্ম স্থাপন করবো আমি, তোমার বিবিকে হরণ করে সুলতানের নিকট সমর্পন করে আর স্বয়ং তোমাকেও জীবিত অবস্থায় সুলতান ঘোরীর হাতে বন্দি হয়ে নরক যন্ত্রণা ভোগ করিয়ে তিলে তিলে মরবো আমি।“
তরাইনের যুদ্ধ এবং ফকিরের অলৌকিক ক্ষমতায় ঘোরীর যুদ্ধ জয়
===========================================
এরপর ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগে নিজের মহলে নিদ্রারত অবস্থায় মহম্মদ ঘোরী স্বপ্নে দেখতে পেলেন দিব্যময় ফকিরকে। স্বপ্নেই ফকির তাকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, “হে সুলতান ওঠো, জাগো আর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। স্বয়ং আল্লাহর নির্দেশ এসেছে হিন্দুস্থান আক্রমণ করে নিম্ন শ্রেণীর কাফের পৌত্তলিকদের ধ্বংস করে ইসলামের বিজয় কেতন উড্ডীন করার। দিল্লি আর আজমীর আমি তোমার হাতে অর্পণ করলাম। এগিয়ে চলো, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে বিজয় তোমার নিশ্চিত।“
ঘুম ভেঙে তৎক্ষণাৎ নিজের 3 সেনাপতি তাজউদ্দিন ইয়ালদিজ, নাসিরউদ্দিন কুবাচা আর কুতুবউদ্দিন আইবককে নির্দেশ দিলেন তুরন্ত সেনা সজ্জিত করে হিন্দুস্থানের রাজ্য দিল্লির দিকে অগ্রসর হবার। স্তম্ভিত সেনাপতিরা সুলতানকে জানালো যে এই মুহূর্তে দিল্লির রাজা রায় পিথোরার (পৃথ্বীরাজ চৌহানের ফার্সি উচ্চারণ) বিশাল শক্তিশালী বাহিনীর মোকাবিলা করবার মতো যথেষ্ট বাহিনী নেই তাদের হাতে। সেনাপতিদের পরামর্শ শুনেও বিন্দুমাত্র দমলেন না ঘোরী। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে যাত্রা শুরু করলেন দিল্লির উদ্দেশ্যে। সংবাদ পেয়ে তুর্কি বাহিনীর প্রতিরোধ করতে নিজের বিশাল বাহিনী সমেত এগিয়ে এলেন রায় পিথোড়াও। দিল্লি আর চণ্ডীগড়ের মাঝামাঝি হরিয়ানা রাজ্যে অবস্থিত তরারীর (ফার্সি ভাষায় তরাইন) প্রান্তরে মুখোমুখি হলো দুই যুযুধান পক্ষ।
পৌত্তলিক কাফের বাহিনীর সংখ্যাধিক্য দেখে শঙ্কিত হলো তুর্কি সেনাপতিদের হৃদয়। অবশেষে শুরু হলো যুদ্ধ। যুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথেই মহম্মদ ঘোরী দেখতে পেলেন এক অদ্ভুত দৃশ্য। সুলতান দেখলেন একটি শ্বেতবর্ণ পক্ষীরাজ ঘোড়ায় আরোহণ করে তরারীর প্রান্তরের উপরে এসে হাজির হয়েছে খোদ ফকির। ফকিরকে অবশ্য সুলতান ছাড়া আর কেউ দেখতে পাচ্ছিল না। যুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথেই রে রে করে ধেয়ে এলো কাফের সেনারা। কিন্তু কি এক অলৌকিক ক্ষমতাবলে তাঁদের নিক্ষিপ্ত একটাও তির, ভল্ল আর অসির আঘাত এসে পৌঁছল না তুর্কি সেনাদের উপর। উল্টে তুর্কি বাহিনীর নিক্ষিপ্ত অস্ত্রের আঘাতে শয়ে শয়ে আর কাতারে কাতারে মরতে লাগলো কাফের সেনারা। দেখতে দেখতেই বিকেলের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে এলো পৃথ্বীরাজের সেনা। এরপর শঙ্কিত রাজা মরিয়া হয়ে নিজের হস্তী বাহিনী নিয়ে অন্তিম প্রয়াস করলেন তুর্কি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার। কিন্তু ঠিক সেই সময় আকাশ এক অদ্ভুত কালো মেঘে ছেয়ে গেল। আকাশের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আচমকা ক্ষেপে উঠলো পৃথ্বীরাজের বাহিনীর হাতিরা। তারা ক্ষেপে গিয়ে পসচাৎ পশরণ করলো এবং প্রবল ক্রোধে মুহুর্মুহু বৃহণ ধ্বনি দিয়ে শুঁড়ের আঘাতে আছড়ে ফেলতে লাগলো খোদ রাজার পৌত্তলিক সেনাদেরই। নিজের হস্তী বাহিনীর পদাঘাতে মৃত্যু হলো পৃথ্বীরাজের অবশিষ্ট সেনার।
অবশেষে যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন অত্যাচারী আর অমানবিক রাজা। পরাজিত রাজা কাপুরুষের ন্যায় ছদ্মবেশ ধারণ করে পলায়নের চেষ্টা করলেন। কিন্তু ফকিরের মায়াজাল ছিন্ন করে পালাতে পারলেন না। কিছু দূরে সরস্বতী নদীর তটে ধরা পড়ে বন্দি হলেন তিনি।
এরপর ফকিরের নির্দেশে রাজাকে ভিখারির বেশে গজনী নিয়ে এসে ঘুর ফাটকের অন্ধকূপে বন্দি করে রাখা হলো। বন্দি রাজাকে ইসলাম কবুল করানোর জন্য নানারকম যাতনা দেওয়া হলো। রাজাকে বলপূর্বক গোমাংস খাওয়ানো হলো, তাঁর দুই চক্ষু তপ্ত শলাকা দিয়ে উপড়ে নেওয়া হলো। কিন্তু ফকিরের অভিশাপে কিছুতেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন না তিনি। এদিকে দিল্লির লালকোটে রাজার অরক্ষিত রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে রাজার রূপসী স্ত্রীকে বলপূর্বক হরণ করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে ফকির তাঁকে বন্দি করে সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
এরপর সুলতানের বাহিনীর সাথে আজমীরে গিয়ে আনাসাগরের তটে অবস্থিত পৌত্তলিক কাফেরদের যাবতীয় দেবালয় ধ্বংস করলেন তিনি। বরাহদেবের সেই বিশাল মন্দির ধস্ত করে নিজের প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী সেখানেই নিজের মাজহার স্থাপন করলেন ফকির বাবা। এরপর দাম্ভিক রাজার পরিবারকে তাদের কুকর্মের উচিত সাজা দিতে বিনা বাধায় আজমীরের প্রাসাদে অনুপ্রবেশ করে পৃথ্বীরাজের দুই কিশোরী কন্যা সন্তানকে তুলে এনে বিবাহ করলেন প্রায় 52 বছর বয়সী ফকির। তিনি প্রৌঢ় বটে কিন্তু অলৌকিক ক্ষমতাবলে তার শরীর এক 22 বছর যুবার ন্যায়। এরপর নিজের প্রতিজ্ঞা মাফিক দিল্লির বুক থেকে অপবিত্র কাফের রাজ খতম করে পবিত্র ইসলাম ধর্ম স্থাপন করলেন তিনি
উপসংহার
=======
আলি আসগর চিস্তির লেখনীতে তরাইনের প্রথম যুদ্ধের কোন উল্ল্যেখ নেই। তার লেখনী অনুসারে ভারত তো দুরস্ত সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে এহেন মহান আর প্রভূত অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী কোন দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। সেই সময়ে জন্মগ্রহণ করলে জাদুকর ম্যানড্রেক, তাঁর পিতা তথা জাদু সম্রাট থেরন, হ্যারি পটার, কিলবিশ, অজিনকিয়া, তারানাথ তান্ত্রিক সহ বিশ্বের তামাম জাদুকর ফকির মঈনউদ্দিন চিস্তির নিকট তালিম নিতে আসতেন। বর্তমানকাল হলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং ইয়ুন একে অপরকে শায়েস্তা করতে সম্ভবত ফকির বাবার শরণাপন্ন হতেন, আল কায়দার প্রয়াত নেতা ওসামা বিন লাদেন আর আই এসের প্রয়াত নেতা আবু বাগদাদিও পৌত্তলিক আর পশ্চিমি দুনিয়ার বিরুদ্ধে তাদের জিহাদে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে বাবার শরণাপন্ন হতেন। কাফের ভারতের বিরুদ্ধে আধুনিক জিহাদে পাকিস্তানের সন্ত্রাসীরাও বিমান, কামান, মেশিনগান আর ক্ষেপণাস্ত্র ফেলে অমিত ক্ষমতাধর বাবার শরণাপন্ন হতেন। এমনকি নরসিংহদীর বিখ্যাত শক্তিশালী ভ্যাম্পায়ার সম্রাট কাউন্ট Robert ক্লাইভ দা ড্রাকুলা ফকিরকে প্রতিরোধ করতে এলে ফকির বাবা রবার্ট ড্রাকুলাকেও পরাজিত ও হত্যা করে যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসাবে কাউন্ট সাহেবের গজদন্ত দুটি ভেঙে নিয়ে পরিষ্কার করে নিজের মাজারে স্বজত্নে গচ্ছিত রাখতেন।

তথ্যসূত্র: আলি আসগর চিস্তি জুয়াহারি ফরিদী লাহোরি ১৮৮৪)

#Post_credit: যোদ্ধা ভারতবাসী



কালাপাহাড় ( দুই )


   কালাপাহাড় ( দুই )


    ফেসবুক থেকে         শেয়ার করেছেন                প্রণব কুমার কুণ্ডু



কালাপাহাড় : এক অসাধারণ প্রেমিকের, নৃশংস হিন্দুবিদ্বেষীর হয়ে ওঠার কাহিনী

# সলিল হোড়

" সময়টা ছিল পঞ্চদশ শতক। বাংলাদেশের গৌড়ের শাসক তখন সুলায়মান খান কররানী। সেখানে তার সেনাবাহিনীতে এক দক্ষ ব্রাহ্মণ সেনানী ছিলেন রাজীবলোচন রায়, যিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজশাহীর অধিবাসী। অত্যন্ত সুদর্শন, বিদ্বান ও বুদ্ধিমান রাজীব ছিলেন এক নিষ্ঠাবান বিষ্ণুভক্ত। কররানীর সেনাবাহিনীতে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়ে, তিনি সুলতানের সুনজরে ছিলেন, আর সেই জন্যই তার অন্দরমহলে যাতায়াতের অনুমতি ছিল রাজীবের।
একদিন এই অন্দরমহলেই রাজীব দেখা পান কররানীর এক মেয়ে, দুলারী বিবির। প্রথম দর্শনেই রাজীব মুগ্ধ হন, যাকে বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট! কিছুদিন পরে দুলারী বিবির থেকেও সাড়া আসতে থাকে। শুরু হয় রাজীব আর দুলারীর প্রেমকাহিনী। একবার ভাব, সেই সময়ে হিন্দু ছেলে আর মুসলিম মেয়ের মধ্যে প্রেম! যাই হোক, অসীম সাহসী রাজীব, একদিন মেয়ের বাবার কাছে, মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। কররানী প্রথমে খুব অবাক হলেও, পরে ব্যাপারটা মেনে নেন। রাজীবকে নিজের প্রধান সেনাপতির পদে আসীন করেন, আর ইসলামমতে বিয়ে হয় রাজীব-দুলারীর। রাজীব কিন্তু তখনো নিজের ধর্ম পরিত্যাগ করেন নি।
এই বিয়ের ফলে, তৎকালীন গোঁড়া হিন্দু সমাজে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। রাজীবকে আর তার পরিবারকে সমাজে একঘরে করে দেওয়া হয়। রাজীবের মা ছেলেকে অনুরোধ করেন যে প্রায়শ্চিত্ত করতে, কিন্তু বাংলার হিন্দু ধর্মগুরুরা, তাকে কোনোরকম বিধান দিতে অস্বীকার করেন। এর কিছুদিন পরে, রাজীব সস্ত্রীক পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে প্রায়শ্চিত্ত করতে গেলে, মন্দিরের পুরোহিতরা খুব খারাপ ব্যবহার করে তাদের তাড়িয়ে দেন। এর ফলে, প্রতিশোধস্পৃহাতে অন্ধ হয়ে, রাজীব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, এবং হয়ে ওঠেন প্রবল হিন্দু বিদ্বেষী, কুখ্যাত হয়ে ওঠেন 'কালাপাহাড়' নামে।
এরপর থেকে শুরু হয়, কালাপাহাড়ের হিন্দু মন্দির আক্রমণ, প্রতিমা ধ্বংস ও লুটপাটের কাহিনী। সম্ভবত ইংরেজি ১৫৬৮ সালে, কালাপাহাড় আক্রমণ করেন পুরীর জগন্নাথ মন্দির। মন্দিরে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়ে, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার কাঠের প্রতিমা উপড়ে, হুগলি নদীর তীরে নিয়ে গিয়ে সেগুলো জ্বালিয়ে দেন।
মন্দির আক্রমণের পদ্ধতি একটু অভিনব ছিল কালাপাহাড়ের। মন্দিরের ভিতরে বড়ো বড়ো পিতলের ঘন্টা আর গরুর চামড়ার বিশাল ঢোল বাজিয়ে এমন ভাইব্রেশন তৈরি করা হতো, যাতে এমনিতেই প্রতিমাতে ফাটল ধরে যায়, আর হাতগুলো খসে পরে। তারপর সবার সামনে প্রতিমা উপড়ে ফেলা হতো। তৎকালীন উড়িষ্যা এবং আসামের একটা বড়ো অংশে কালাপাহাড় তার অভিযান চালিয়েছিলেন। বালেশ্বরের গোপীনাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরের কাছে কোনারক মন্দির, মেদিনীপুর, ময়ূরভঞ্জ, কটক ও পুরীর মন্দিরগুলো, আর এদিকে আসামের কামাখ্যা ও হাজোর মন্দিরগুলোতে তিনি অবাধে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়েছিলেন।
হিন্দু মন্দির ধ্বংসের সাথে সাথে, আজীবন মুঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন কালাপাহাড়। কররানীদের পতনের পর, কালাপাহাড় সম্ভবতঃ আফগান নেতা মাসুম কাবুলীর দলে যোগ দেন। সম্ভবতঃ ইংরেজি ১৫৮৩ সালে, মুঘল সেনাপতি খান ই আজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কাবুলী পরাস্ত হলে, সেই যুদ্ধে কালাপাহাড়ও নিহত হন। ওড়িশার সম্বলপুরে, মহানদীর তীরে কালাপাহাড় ও তার সহযোদ্ধাদের সমাধিস্থ করা হয়।"
তাহলে ওদিকে গেলে দেখা যাবে তো কালাপাহাড়ের সমাধি?

আর সমাধি! কালাপাহাড় মন্দির নষ্ট করেছিল, আর সেই জন্য ২০০৬ সাল নাগাদ কিছু উগ্র হিন্দুবাদীর আক্রোশে তার সমাধি ধ্বংস হয়!



স্বর্ণকুমারী দেবী


স্বর্ণকুমারী দেবী


ফেসবুক থেকে      শেয়ার করেছেন             প্রণব কুমার কুণ্ডু




নিউজ ফীড

সুজয় কর্মকার
১৫ মে, ২০১৭ · tag সুজয় কর্মকার(সদস্য), ৩ others
স্বর্ণকুমারী দেবী: বহুমুখী প্রতিভার এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~`~~~~~~~~~`~~

বাংলায় প্রথম উল্লেখযোগ্য মহিলা-ঔপন্যাসিকের নাম নিঃসংশয়ে স্বর্ণকুমারী দেবী। ঠাকুরবাড়ীর অন্যান্য তারকার মত স্বর্ণকুমারীও মধ্যাহ্ন-আকাশে রবির উজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় স্বভাবিকভাবেই অনেকখানি ঢাকা পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের বিস্ময়কর বহুমুখী প্রতিভাবলেই নিজের দুর্ভাগ্যকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর কালেই দেশে বিদেশে যেভাবে সমাদৃত ও অভিনন্দিত হয়েছিলেন কালের বিচারে তা ছিল অভূতপূর্ব এবং বলা যায় ঈর্ষণীয়ও।

ঠাকুরবাড়ীর পরিশীলিত সাংস্কৃতিক পরিবেশে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিলেন স্বর্ণ। তাঁর স্বতন্ত্র কিছু গুন পিতা দেবেন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ভোর হতে না হতেই বাগান থেকে আঁচল ভরে ফুল তুলতেন। প্রিয় ফুলগুলি পিতাকে উপহার দিতেন। পারতপক্ষে ছেলেরা বাবার কাছ না ঘেঁসলেও মহর্ষির কন্যাদের প্রতি ছিল স্নেহপূর্ণ সজাগ দৃষ্টি। রূপে গুনে অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়ী স্বর্ণকুমারীকে ঠাকুরবাড়ীর সকলেই একটু অন্য চোখে দেখত। স্বর্ণকুমারী পিতার আদর, মায়ের স্নেহ, ভাইদের ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন নিজগুনে। অন্তঃপুরেই তিনি শিক্ষালাভ করেছিলেন। মহর্ষী স্বর্ণকুমারীর একটি লেখা পড়ে পাশে লিখে দিয়েছিলেন, 'স্বর্ণ, তোমার লেখনিতে পুষ্পবৃষ্টি হউক'।

পিতার পরেই স্বর্ণকুমারীর হৃদয়ে যাঁর বিরাট আসনটি পাতা ছিল, তিনি সত্যেন্দ্রনাথ। ঠাকুরবাড়ীর মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার যে বীজ দেবেন্দ্রনাথ বপন করছিলেন তাকে বাইরের আলো হাওয়া দিয়ে পল্লবিত করে তুলেছিলেন তাঁর মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ। স্বর্ণকুমারী দেবী তাঁর একটি প্রবন্ধে বলেছেন 'বাড়ীর মেয়েরা সকলেই জানিত, মেজদার মত সহায় বন্ধু তাহাদের আর কেহ নাই; তাঁহার উপর সকলেরই বিশ্বাস ছিল অসীম।' স্বর্ণকুমারীর সঙ্গে মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের আজীবন একটি অন্তরঙ্গ যোগ ছিল। স্বর্ণকুমারীর জীবনের অনেক অংশই কেটেছে তাঁর মেজদার কাছে প্রবাসে। মেজদার অফুরন্ত ভালোবাসা পেয়েছিলেন তিনি।

ভালোবাসা পেয়ছিলেন তাঁর জ্যোতিদাদারও। স্বর্ণকুমারীর সাহিত্যসাধনার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তিনি বাড়ীর মেয়ে বউদের একত্র করে ইংরেজী গল্প তরজমা করে শোনাতেন। স্বর্ণও ছোট ছোট গল্প রচনা করে তাঁর জ্যোতিদাকে শোনাতেন। নতুনদা মানেই আড্ডা,আনন্দ, হুল্লোড়, গান, গল্প, কথকতা। পিয়ানো বাজিয়ে সুর তুলতেন, গান করতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। গান শুনে মোহিত হতেন স্বর্ণকুমারী। যোগ দিতেন দাদার সঙ্গে। ঠাকুরবাড়ীর মেয়েলি আড্ডা বা রান্নঘরের কাজে স্বর্ণকুমারী থাকতেন না। তিনি থাকতেন,পড়াশোনা, লেখালেখি, নিয়ে। সাহিত্য -সংগীতে ভাইবোনে ছিলেন কাছাকাছি। এমনি করে দাদাদের স্নেহ-আদরে বড় হতে লাগলেন স্বর্ণকুমারী। চলতে লাগল সাহিত্য-চর্চাও।

কৃষ্ণনগরে ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করতে গিয়ে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর কিশোরী কন্যা আদরের স্বর্ণের জন্য বর খুজে আনলেন। পাত্র জানকীনাথ ঘোষাল। জয়রামপুর গ্রামের জয়চন্দ্র ঘোষালের ছোট ছেলে। শিক্ষিত, সুদর্শন। সবচেয়ে বড় কথা মনটি তাঁর সংস্কার মুক্ত। চিরকালের জেদী এবং তেজী ছেলেকে জামাই করতে গিয়ে ঠাকুরবাড়ীর মেয়েকে বিবাহের দুটি শর্ত ( ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হওয়া এবং ঘর জামাই হয়ে থাকা) জলাঞ্জলি দিতে হল। তা হলেও ঠাকুরবাড়ী পেল একটি রত্ন। শুধু স্বর্ণকুমারী নয় জোড়াসাকোর ঠাকুর পরিবারের সকলের ভালোবাসা জয় করেনিলেন বিরাট হৃদয়ের এই মানুষটি। খুশি হলেন স্বর্ণ।সেই সঙ্গে খুশি ঠাকুরবাড়ির ছোট বড় সকলেই। বিয়ের পর স্বর্ণকে নিয়ে গেলেন জানকীনাথ শিয়ালদায় একটি বাড়ীতে।

বিপত্তি বাধল অন্য জায়গায়। মহর্ষির মেয়েকে বিয়ে করায় প্রাচীন ঋষিদের মত ক্রোধে জ্বলে উঠলেন জানকীনাথের পিতা জয়রাম ঘোষাল। ত্যজ্যপুত্র করলেন ছেলেকে। শুধু তাই নয়, দুহাতে সম্পত্তি ওড়াতে লাগলেন। ভবিষ্যতে ছেলের হাতে যেন না পড়ে। ছেলেও সমান ক্রোধালু। সে অন্যায় কিছু করেনি 'ঘোষালে রাগ' তাঁরও আছে। শুধুমাত্র সংস্কারের কাছে মাথা নোয়াতে তাঁর বিবেক অক্ষম। অবশেষে হার মানতে হল জয়রাম ঘোষালকে। বৌমা এবং নাতি নাতনীদের জন্য স্নেহের আসন পেতে দিলেন। উজাড় করে দিলেন ভালোবাসা। তাঁর পরাভবের মধ্যেই লুকিয়ে আছে স্বর্ণকুমারী এবং জানকীনাথের নিবিড় ভালোবাসার প্রমাণ।

জানকীনাথের চিরকালই মনটি ছিলসংস্কার মুক্ত । তাঁর স্বর্ণ সংসারের ঘেরাটোপে আটকা পড়ে যাক, এ তিনি চাননি। তাই নিজে যেবার আইন পড়তে বিলাত গেলেন স্বর্ণকে পাঠিয়ে দিলেন জোড়াসাঁকোয়। উদ্দেশ্য স্ত্রীর জীবনে সাহিত্য সংস্কৃতির আকর্ষণকে নিভে যেতে না দেওয়া। স্বর্ণ ফিরে এল জ্যোতিদাদার সান্নিধ্যে। সেদিন দুজনের মনে কি আনন্দ! আবার শুরু হল সাহিত্যচর্চা, গানের আসর। মনে সাহস আর উৎসাহ পেয়ে উপন্যাস রচনায় হাত দিলেন। জ্যোতিদাদার স্নেহানুকুল্যে "দীপনির্বান" নামে একটি উপন্যাস লিখে স্বর্ণকুমারী সে সময় সাহিত্যিক মহলে হৈচৈ ফেলে দিলেন। কিছুদিন পর 'পৃথিবী' নামে একখানি গভীর গবেষণা মূলক বই লিখে স্বর্ণকুমারী সকলের প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের আসরে তিনি আদায় করে নিলেন প্রার্থিত সম্মান-যা তাঁর পথচলাকে আরো সুগম করেছিল।

অন্তঃপুরে বসেই স্বর্ণকুমারী রচনা করলেন এক অপূর্ব গীতিনাট্য 'বসন্তোৎসব'। রবীন্দ্রনাথ তখন বিলাতে। জ্যোতিদাদার উৎসাহে সেটি অভিনীত হল। সেদিন সঙ্গীতের এক মহা হিল্লোলে হিল্লোলিত হল ঠাকুরবাড়ী। সাহিত্যচর্চার এই অভ্যাসটি স্বর্ণকুমারীর বিবাহ-পরবর্তী জীবনেও অব্যাহত থাক। সেই সঙ্গে যুক্ত হল সামাজিক, রাজনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে তাঁর বিবিধ ও বিচিত্র সৃজনশীল কার্যকলাপ। নারীকল্যানে নিবেদিতপ্রাণা স্বর্ণকুমারী অনাথ, অসহায় বিধবাদের সমাজে পুনর্বাসনের জন্য স্থাপন করলেন সখিসমিতি' -সেটি পরবর্তীকালে কন্যা হিরন্ময়ীর প্রচেষ্টায় 'বিধবা শিল্পাশ্রমে' পরিনত হয়। তিনি আজীবন এগুলির সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁর স্বদেশপ্রীতি ও রাজনৈতিক সচেতনতার প্রমান মেলে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের পঞ্চম ওষ্ঠ অধিবেশনে প্রতিনিধি হিসাবে যোগদানে।

সাহিত্য সংসারে স্বর্ণকুমারীর বড় অবদান ১৮৮৪ তে 'ভারতী' সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে উপন্যাস, গল্প, কবিতা,ও প্রবন্ধে 'ভারতী'র ডালি সাজানো। শুধু নিজের লেখা না, তিনি লেখক-গোষ্ঠীও তৈরী করে গেছেন। এই মহীয়সী মহিলা আঠারো বছর ধরে তখনকার ঐতিহ্যবাহী'ভারতী' পত্রিকার সম্পাদকের পদে আসীন ছিলেন-একজন মহিলার পক্ষে সহজ কথা নয়। সাহিত্যের সব শাখাতেই তিনি কলম চালনা করেছেন। লিখেছেন গল্প নাটক, প্রহসন, কবিতা গাথা, গান রম্যরচনা প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, গীতিনাট্য, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ কাহিনী, স্কুল পাঠ্য বই- একজন মহিলার পক্ষে যা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। এ অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন স্বর্ণকুমারী। সেই সময় Calcutta Review IndianMirror Sunday Mirror, Hindoo Patriot প্রভৃতি সাময়িক পত্র ও সংবাদপত্রগুলিতে তাঁর বইয়ের সুখ্যাতিমূলক সমালোচনা বের হয়েছিল।

স্বর্ণকুমারীর সুদীর্ঘ জীবন বাণী-সাধনায় সমুজ্জ্বল। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল :'দীপনির্বাণ', 'ছিন্নমুকুল', ' 'হুগলীর ইমামবাড়ী', 'স্নেহলতা', 'বিদ্রোহ', 'মিবাররাজ', 'ফুলের মালা', 'কাহাকে?' 'নবকাহিনী', 'মালতী' 'বসন্ত-উৎসব' 'গাথা', 'কবিতাও গান','কৌতুকনাট্যও বিবিধকথা' 'পৃথিবী' 'বল্যবিনোদ' 'গল্প-স্বল্প' 'বর্ণবোধ', 'দেব কৌতুক', 'বিবাহ উৎসব', 'কনেবদল', 'পাকচক্র', 'রাজকন্যা', 'নিবেদিতা','বিচিত্রা' 'স্বপ্নবাণী', 'যুগান্ত কাব্যনাট্য' 'মিলন-রাত্রি' ও'দিব্য-কমল'। 'গীতি -গুচ্ছ' ও'প্রেমগীতি' নামে দুখানা স্বরলিপির বই, ফুলের মালা এবং কাহকে?র ইংরেজি অনুবাদ যথাক্রমে The Fatal Garland এবংAn Unfinished Song. নামে প্রকাশিত হয়েছে।

স্বর্ণকুমারীর দুই মেয়ে। এক ছেলে। বড় মেয়ে হিরন্ময়ী। তারপর ছেলে জ্যোৎস্নানাথ। তারপরে সরলাদেবী। 'ভারতী' সম্পাদনার কাজে তিনি মেয়েদের সাহায্য পেয়েছিলেন। হিন্ময়ীর বিবাহ হয়েছিল রাজশাহীর অধ্যাপক ফনীভূষন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সরলার বিবাহ হয় পাঞ্জাবের আর্যসমাজ নেতা পন্ডিত রামভজ দত্তচৌধুরীর সঙ্গে। পুত্র জ্যোৎস্নানাথের বিয়ে হয় কেশব সেনের কন্যা কুচবিহারের মহারাণী সুনীতি দেবীর জ্যৈষ্ঠা কন্যা রাজকুমারী সুকৃতির সঙ্গে। জ্যোৎস্নানাথ বোম্বাই এবং পুনায় রত্নগিরি জেলার জজ ছিলেন। পরে বোম্বাই হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছিলেন। স্বর্ণকুমারীর আরো একটি কন্যাসন্তান ছিল। নাম তার উর্মিলা। ছোট্ট উর্মিলাকে নিঃসন্তান বৌঠান কাদম্বরী দেবী কন্যাস্নেহে পালন করছিলেন। উর্মিলা থাকত কাদম্বরীদেবীর সাথ ঠাকুরবাড়ির তেতালায়। সিড়ি থেকে পড়ে গিয়ে শৈশবেই উর্মিলার মৃত্যু হয়। এই দুর্ঘটনা না ঘটলে ঠাকুরবাড়ীর ইতিহাস অন্যরকম হত। কাদম্বরী দেবী হয়ত অকালে সরে যেতে পারতেন না।

আলোক-বর্তিকা হাতে নিয়ে আগে আগে পথ দেখিয়ে স্বর্ণকুমারীকে যিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন -সেই জানকীনাথ ঘোষাল মারা গেলেন। মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়লেন স্বর্ণকুমারী। সমস্ত ঝড়-ঝাপটা দুর্যোগ থেকে তাঁকে রক্ষা করে, সাহিত্যক্ষেত্রে সার্থক করে তুলতে তাঁকে এগিয়ে দিয়েছে জানকীনাথ ঘোষালের ভালোবাসা। এতদিন তাই পথের কাঁটাও বুঝি তাঁর পায়ের তলায় ফুল হয়ে ফুটে উঠেছে। স্বামী হারিয়ে অসহায় ক্লান্ত স্বর্ণকুমারী জীবনের সব আনন্দ যেন শেষ গেল। 'ভারতীর' দায়িত্বভার ছেড়েদিয়ে বাইরের পৃথিবী থেকে একপ্রকার নিজেকে সরিয়ে নিলেন। তাঁর কথায়, ".. এমন স্বামী পাওয়া বহুপুণ্যের ফল: চিরদিন আমার সুখ কিসে হবে তাই দেখেছেন..এমন স্বমীকে কি করে ভুলবো।" না। তিনি ভুলতে পারেননি। পরজন্মে আবার স্বামীর সাথ মিলিত হবেন-এই বিশ্বাস নিয়ে তিনি চলে গেলেন ৩রা জুলাই ১৯৩২।

বঙ্গীয় সাহিত্য জগতে এমন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রমনীব্যক্তিত্ব দ্বিতীয় আর নেই। প্রায় ছ'দশক জুড়ে সাহিত্য সৃষ্টির কাজে নিজেকে ব্যপৃত রেখেছিলেন। ইঁহার পূর্বে অন্য কোন মহিলা বাংলা ভাষায় উপন্যাস গীতিনাট্য,অথবা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখেছেন বলে মনে হয় না। তিনি ছিলেন 'ভারতী'র মত প্রথম শ্রেনীর একটি মাসিক পত্রিকার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সফল এডিটর। এতবড় মাপের একজন সাহিত্যিক-সম্পাদক ও তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? স্বীকার করতেই হয়, না, জানিনা। এ আমাদের পরিতাপ ও লজ্জার কথা। তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করা, তাঁর সৃষ্টির নতুন করে মূল্যায়ণ করা, তাঁর যোগ্য আসনে তাঁকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা আমাদের কালের কর্তব্য।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------বই:--
"স্বর্ণকুমারী দেবী -স্বতন্ত্র এক নারী: সম্পাদনা অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য।
"স্বর্ণকুমারী দেবী":-মীনা চট্টোপাধ্যায়।
"স্বর্ণকুমারী দেবী":-শ্রী ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়।
"যাদের সংস্পর্শে এসেছি": জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ।

জলময়ূর


     জলময়ূর


      ফেসবুক থেকে           শেয়ার করেছেন               প্রণব কুমার কুণ্ডু


Suman Basak এতে Indian Birds
Pheasant Tailed Jacana ( জল ময়ূর )
Rajarhat, Kolkata,West Bengal, India .
Nikon D7000 With Nikkor 200-500mm Lens.  
Aperture f5.6.Shutter Speed 1/800sec....